স্পেনে পিপিই সংকট, জীবন বাজি রেখে লড়ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই সর্বোচ্চ আক্রান্তের দেশ স্পেন। দেশটির হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় এবং পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না থাকায় মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন সেখানের স্বাস্থ্যকর্মীরা।
আজ রোববার এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চীনের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্পেনে মোট আক্রান্তের ১৪ শতাংশই স্বাস্থ্য কর্মী। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, রোববার পর্যন্ত দেশটিতে ১৫ হাজারেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। তারা করোনার চিকিৎসার সময় রোগীদের সংস্পর্শে আসার কারণে আক্রান্ত হয়েছেন।
এক সপ্তাহ আগে করোনা আক্রান্ত অ্যাম্বুলেন্সকর্মী জেভি ম্যাতেউ। তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় সর্তক থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আমরা যেখানে কাজ করি সেখানের কেউ আক্রান্ত কিনা তা বোঝার উপায় নেই। আবার কোনো উপসর্গ প্রকাশ নাও পেতে পারে। তাই নিজের অজান্তে যে কেউ অন্যকে আক্রান্ত করতে পারেন।’
কাতালোনিয়ার বাসিন্দা ম্যাতেউ জানান, কাজের ফাঁকে খাবারের বিরতির সময় তিনি হয়তো করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা থেকে সুরক্ষিত থাকতে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল তা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য যত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বরাদ্দ ছিল সবগুলোই ব্যবহার করেছি। এই মুহূর্তে ভবিষ্যতে নিয়ে চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই।’
কাতালোনিয়ার জরুরি সেবায় নিয়োজিত আরেক কর্মী অ্যালবার্ট গ্যোল। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন।
তিনি বলেন, ‘প্রথমদিকে কিছু নিয়ম মানা হতো। কিন্তু, রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসব মেনে চলা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে একবার ব্যবহারের পরেই আমরা মেডিকেল স্যুট, মাস্ক ও চশমা ফেলে দিতাম। পরে, এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় একদিনে একটি মাস্ক ব্যবহার করতে হয়েছে।’
নিজে আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে পিপিই’র সংকটকে দায়ী করেন তিনি। বলেন, ‘গতকাল এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে জানাল, হাসপাতালে এখন জরুরি সরঞ্জাম নেই। সাধারণ মেডিকেল সামগ্রীও ফুরিয়ে আসছে, এমনকি পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীও নেই। মেডিকেল স্যুটগুলো জীবাণুমুক্ত করে বারবার ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেগুলো ছিদ্র হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবহার করতে হবে।’
স্পেনের অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এখন ময়লা ফেলার কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে নিজেদের পিপিই বানিয়ে নিচ্ছেন।
চিকিৎসাকর্মীদের চাপ কমাতে নতুন লাইসেন্স প্রাপ্তদের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদেরও কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত বছর মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন করেন ক্যান্ডেলা লেব্রেরো। নির্দেশ মেনে বর্তমানে মাদ্রিদ প্রিন্সিপ দ্য আস্টুরিয়াস হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করছেন।
ক্যান্ডেলা জানান, জরুরি বিভাগে জায়গা না থাকায় তুলনামূলক কম অসুস্থ যারা তাদেরকে ‘মেডিকেলাইজড হোটেলে’ কিংবা যেসব হাসপাতালগুলোতে নতুন ওয়ার্ড চালু হয়েছে সেখানে পাঠানো হচ্ছে।
হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়ের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের অনেক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখনো এখানে দ্রুত শনাক্তকরণ কিট এসে পৌঁছায়নি। সোয়াব টেকনিকের মাধ্যমে পিসিআর টেস্ট করা হচ্ছে।’
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৬ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
স্পেনের অন্যান্য শহরের হাসপাতালেও প্রায় একই দৃশ্য। গত ৩০ মার্চ দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ফার্নান্দো সিমোন করোনায় আক্রান্ত হন। এর আগে ২৫ মার্চ তিনি স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই সরবরাহের ক্ষেত্রে অসুবিধার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে জরুরি মেডিকেল সরঞ্জামের ব্যাপক চাহিদার কারণে এগুলো এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য। এটা কেবল স্পেন নয়, গোটা বিশ্বের সংকট। তবে, আমরা খুব দ্রুতই সমাধানের দিকে যাচ্ছি।’
মূলত ইউরোপের অন্য দুটি দেশ ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে স্পেনে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। মার্চের শুরুতে ফ্রান্স ও জার্মানিতেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে স্পেনে এগুলো রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংকট মোকাবিলায় চীন থেকে ৪৩২ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তি করে স্পেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেতনার পরিপন্থী বলে স্পেনের এই উদ্যোগের ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংকট মোকাবিলায় প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে স্পেন। চীন থেকে পাঠানো মেডিকেল সামগ্রী যাতে জটিলতা ছাড়াই দ্রুত এসে পৌঁছাতে পারে সেজন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশটির টেক্সটাইল শিল্পের কর্মীরা সুরক্ষা স্যুট ও মাস্ক উৎপাদন শুরু করেছেন। খেলাধুলার সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ডিক্যাথলন হাসপাতালে ব্যবহারের উপযোগী চশমা তৈরি করেছে। এসব চশমা বিনামূল্যে স্পেনের বিভিন্ন হাসপাতালে বিতরণ করা হচ্ছে।
ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় গত মাসে চীন থেকে পাঠানো ৫৮ হাজার দ্রুত শনাক্তকরণ কিট প্রত্যাহার করে স্পেন। ভাইরাস শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এগুলো মাত্র ৩০ শতাংশ কার্যকর বলে দাবি করেন সেখানকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
প্রত্যাহারের পর চুক্তি অনুযায়ী চীন থেকে উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানোর কথা থাকলেও এখনো হাসপাতালে সেগুলো পৌঁছায়নি বলে জানান কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মী।
স্টেট কনফেডারেশন অব মেডিকেল ইউনিয়নের প্রচারকর্মী লরা দিয়াজ বলেন, ‘চীন থেকে মেডিকেল সরঞ্জাম স্পেনে পৌঁছেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু, অনুমোদন দেওয়ার আগে এগুলো কারলোস থার্ড পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে। ওই সরঞ্জাম অনুমোদন পেলেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসতো। অন্তত দ্রুত শনাক্তকরণ কিটগুলোর মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার রোধ সম্ভব হবে।’
শুক্রবার স্পেনের এক মন্ত্রী জানান, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে অনেকেরই কোভিড-১৯ এর স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু, উপসর্গ দেখা দিয়েছে বলে ছুটিতে আছেন। ছুটিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মীদের সাত দিনের মধ্যে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট ভালো হয়ে গেলে তাদের কাজে ফিরে আসতে হবে বলে।
কাজে ফেরার পর ১৪ দিন পর্যন্ত সবসময় তাদেরকে সার্জিকাল মাস্ক পরে থাকার ও অন্যান্য মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দেশটির এমন নির্দেশনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক, নার্স ও ফার্মাসিস্ট কাউন্সিলের প্রায় ৭ লাখ কর্মী। তারা জানান, এ ধরনের নির্দেশনা আমরা প্রত্যাখ্যান করি। এর কারণে স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগী উভয়ই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
অ্যাম্বুলেন্স কর্মী জেভি ম্যাতেউ জানান, বর্তমানে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি সহকর্মীদের নিয়ে চিন্তিত। এখনো যারা জীবন বাজি রেখে লড়ছেন তাদের প্রত্যেকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। অনেক সহকর্মীদের অসুস্থ হতে দেখেও তারা ঘাবড়ে না গিয়ে নিয়মিত কাজের চাপ সামলাচ্ছেন।’
Comments