মানবদেহে করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষা: উহানের স্বেচ্ছাসেবকের অভিজ্ঞতা

করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চীনের স্বেচ্ছাসেবক। ছবি: উইবো

করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে নিরলস কাজ করে চলছেন বিজ্ঞানীরা। মহামারি ঠেকাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ সাহায্য করছেন অনেক স্বেচ্ছাসেবক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩৫টি একাডেমি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে করোনার টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে সামনের সারিতে আছে চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস ও যুক্তরাষ্ট্রের মর্ডানা থেরাপেউটিকস। এই দুই প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে করোনা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়েছে।

চীনে গত ১৯ মার্চ থেকে ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল উহানের ১০৮ জন স্বেচ্ছাসেবক এতে অংশগ্রহণ করেন।

এমনই একজন স্বেচ্ছাসেবক জিয়ান ইয়াফি (৩০)। তিনি একটি রেস্টুরেন্টের মালিক। সংবাদ সংস্থা সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে নিজ দেহে করোনার ভ্যাকসিন পরীক্ষার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানান তিনি।  

ঝুঁকি সত্ত্বেও ভ্যাকসিন ট্রায়ালের জন্য আপনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশ নিতে চাইলেন কেন?

গত জানুয়ারিতে উহানে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে শুরু করি। মার্চের মাঝামাঝিতে এক বন্ধু ভ্যাকসিন পরীক্ষার বিষয়টি আমাকে জানায়।  

শুরুতে আমি ভয় পেয়েছিলাম কারণ ভ্যাকসিন কাজ করবে কিনা সেটা এখনো অনিশ্চিত। আমি বেশ কয়েকজনকে এর ঝুঁকির ব্যাপারে জিগ্যেস করেছিলাম। আমার বন্ধুরা জানায়, ভ্যাকসিন পরীক্ষার স্বেচ্ছাসেবক হওয়াটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য আমার দেহে এক ধরনের ভাইরাস ইনজেকশনের মাধ্যমে ঢোকানো হবে। আমি ইন্টারনেটে এ বিষয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। 

আমার কাছে মনে হয়েছে, যেহেতু একাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সে (চীনা সামরিক মেডিকেল গবেষণা ইনস্টিটিউট-পিএলএ) ও ক্যানসিনো এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে তাহলে নিশ্চয়ই তারা সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। আমার পিএলএর প্রতি আস্থা আছে। আমার অনেক আত্মীয় সেখানে কাজ করতেন। এসব ভেবে আমি ট্রায়ালের জন্য রাজি হই। কিন্তু, আমি বাড়িতে জানাইনি। কারণ আমি চাইনি আমার মা-বাবা দুশ্চিন্তা করুক।

ইন্টারনেটে স্বেচ্ছাসেবক চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগেই ১৬ মার্চ আমি তাদের অফিসে যাই। ফরম পূরণ করি। সৌভাগ্যবশত সেদিন মেজর জেনারেল চেন ওয়েইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি ওই দলটিকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আমাকে তিনি ভ্যাকসিন সম্পর্কে জানান। বলেন, এটি আমার শরীরের কোনো ক্ষতি করবে না। আমি আত্মবিশ্বাস পাই। 

কখন ইনজেকশন নিয়েছিলেন? তখন কেমন লেগেছিল? 

১৯ মার্চ সকালে আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়। এরপরই আমাকে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। পিএলএ কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপে আমার নম্বর ছিল ০০৬, অর্থাৎ আমার আগে পাঁচ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। ইনজেকশন দেওয়ার আগে আমার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। পরে আমি জানতে পারি আরও পাঁচ হাজার ২০০ মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য আবেদন করেছে।

আমি এর আগে জীবনে যতবার ইনজেকশন নিয়েছি সেগুলোর মতোই এর অভিজ্ঞতা। আমার কোনো ব্যথা লাগেনি। ইনজেকশন দিতে ১০ সেকেন্ডের মতো সময় লেগেছে। 

তখন আমার নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারি করোনাভাইরাস মহামারিতে ভ্যাকসিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই বাজারে ছাড়ার আগে এর সঠিকভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা জরুরি। এরকম একটি কাজের অংশ হতে পেরে আমার বেশ ভালো লেগেছে।

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা কাজ করা। একাডেমিশিয়ান চেন (মেজর জেনারেল ও চীনা একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্য) ও তার দলের ছয় সদস্যকেও পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। চেনই প্রথম করোনা পরীক্ষার ভ্যাকসিন নিয়েছেন।

তাদের মধ্যে কোনো খারাপ উপসর্গ দেখা যায়নি। তাই সে মুহূর্তে আমার ভয় লাগেনি। আমার মনে হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিনটি সফল।

ভ্যাকসিন নেওয়ার পর থেকে আপনার শারীরিক অবস্থা কেমন? আপনি কি সুস্থ আছেন?

প্রথম দুইদিন আমার গায়ে হালকা জ্বর ছিল। ৯৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো। অনেকটা সর্দিজ্বরের মতোই ক্লান্ত লাগছিল। তৃতীয় দিন আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়। এরপর থেকে আমি সুস্থ।

বিভিন্ন ডোজের ভ্যাকসিন পরীক্ষার জন্য ১০৮ জন স্বেচ্ছাসেবককে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছিল। নিম্ন, মধ্যম ও উচ্চ মাত্রার। আমি নিচের গ্রুপে ছিলাম তাই কেবল একটা ইনজেকশেনই দেওয়া হয়েছে। মধ্যেম গ্রুপের সদস্যদেরও একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়। উচ্চ মাত্রার গ্রুপের সদস্যদের দুটি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। 

আমি যতদূর জানি, তারা সবাই ইনজেকশন নেওয়ার পর সুস্থ আছেন।

আপনার ট্রায়ালের ফলাফল কবে দেওয়া হবে?

গত ২ এপ্রিল আমার কোয়ারেন্টিন শেষ হয়েছে। আমাকে এরপর সিটি স্ক্যান করা হয়। গবেষকরা পরীক্ষার জন্য আমার রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তারা জানান, রক্তে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা দুই সপ্তাহ পর জানা যাবে।

আমাকে ফলাফল জানানো হবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু এর পরের পাঁচ মাস আমাকে আরও চারবার রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে। যতদিন পর্যন্ত ভ্যাকসিন আমার শরীরে থাকবে ততদিনই অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা পরীক্ষা করে দেখা হবে। 

কোয়ারেন্টিনের সময়টা কেমন কেটেছে?

আমি পুরোটা সময়ই বিশ্রামে ছিলাম। এর আগে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের কাজ করেছি। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি। তাই, প্রায় এক মাস আমি একেবারেই বিশ্রামের সুযোগ পাইনি। ওই ১৪ দিন বিশ্রাম নিয়েছি, ঘুমিয়েছি। প্রতিদিন সময়মতো আমাকে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হতো। সব মিলিয়ে আমার সময় ভালো কেটেছে।

স্বেচ্ছাসেবকদের রুমের বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল। আমরা প্রতিদিন শরীরের তাপমাত্রা মেপে রিপোর্ট করতাম। কারো মধ্যে কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা জানানোর নির্দেশ ছিল।

আমি বই পড়ে, শরীরচর্চা করে সময় কাটাই। অনেকেই ক্যালিগ্রাফি অনুশীলন করে। সময় কাটাতে কেউ কেউ আবার টয়লেট পেপার রোল দিয়ে একা একাই ফুটবল খেলেছে। কেউ গান লিখেছে, তাতে সুর দিয়েছে। অনেকে তাদের প্রতিদিনের জীবন ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়েছে। কিন্তু আমরা সবাই নিজ নিজ ঘরেই ছিলাম। 

অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন। 

এটা ছিল অনেকটা প্রতিযোগিতার মতো। যতদ্রুত সম্ভব রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হতো। বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ের এক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। 

শুরুতে আমি এধরনের কাজ করতে চাইনি। ভয় পেয়েছিলাম। কারণ অধিকাংশ রোগীই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। 

যখন জানতে পারলাম যে, কেউই অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কাজ করতে চাইছে না তখন আমি রাজি হই। আমার গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল। এছাড়াও আমার মনে হয়েছে এরকম দুর্যোগের সময়ে সমাজের জন্য কিছু করা উচিত।

মহামারিতে আপনার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় কেমন প্রভাব পড়েছে?

উহানে আমার রেস্টুরেন্ট আছে। গত তিন মাসে প্রায় ৭০ হাজার ডলার লোকসান হয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি, লকডাউনের দুদিন আগে আমি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেই। অনেকের কাছেই তখন শুনছিলাম যে, লকডাউন হতে পারে। রেস্টুরেন্টের কর্মচারী যাদের বাড়ি উহানের বাইরে তারা যাতে বাড়ি ফিরে যেতে পারে সেজন্য আমি লকডাউন ঘোষণার আগেই ছুটি দিয়ে দেই। রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেই।

এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় রেস্টুরেন্ট খোলার পরিকল্পনা আছে। জীবাণুমুক্ত ও সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার করার পরই রেস্টুরেন্ট খুলব। 

প্রায় আড়াই মাস পর উহানের লকডাউন উঠতে চলেছে। আপনার কেমন লাগছে?

উহানের পরিস্থিতি দিনদিন ভালো হচ্ছে। আমরা গর্বিত যে আমরা শহরটাকে বাঁচাতে পেরেছি। আশা করি, শিগগিরই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে ও আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব। 

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

11h ago