ধর্ষক, চোর ও ঘুষখোরের দেশে করোনা
বোধ হয় আমাদের কিছুই বদলাবে না। একটি ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবী যেখানে অচল; পুরো পৃথিবীর মানবজাতি এক ভয়াবহ সংকটে নিপতিত এবং কবে এই মহাবিপর্যয় থেকে তাদের মুক্তি মিলবে সেই আশায় দিন গুণছে; যখন সারা পৃথিবীর মানুষ এখন মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ যে, যেভাবেই হোক এই অদৃশ্য শত্রুকে পরাস্ত করতেই হবে; যখন বলা হচ্ছে করোনাউত্তর পৃথিবীতে হয়তো অনেক কিছুই বদল যাবে, ক্ষমতার কেন্দ্র পাল্টে যাবে, বিশ্বনেতাদের চিন্তায়ও হয়তো পরিবর্তন আসবে— সেই মুহূর্তেও আমাদের দেশে পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত নেই।
এই মহাদুঃসময়ে যখন মানুষ ‘ইয়া নফসি’তে ব্যস্ত; যখন কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তার সবচয়ে প্রিয় মানুষটিও তার কাছে যাচ্ছে না; যখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কিংবা করোনার উপসর্গ নিয়ে বাবার মৃত্যু হলে সন্তানও জানাজায় যাচ্ছে না; এমন এক চরম বৈরী সময়েও দেশে থেমে নেই ধর্ষণ, চুরি, ঘুষ। বরং এই ভয়াবহ দুঃসময়কে পুঁজি করেই নিজেদের আসল চেহারা উন্মোচিত করছে কিছু প্রাণী— যাদেরকে বাইরে থেকে মানুষের মতো দেখা যায়।
খবর ১. ত্রাণের জন্য ডেকে নিয়ে ধর্ষণ
করোনাভাইরাসের কারণে বেকার হয়ে খাদ্য সংকটে পড়া এক দিনমজুর পরিবারের মেয়েকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন একজন ইউপি সদস্য। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ এপ্রিল বরগুনার তালতলী উপজেলার শারিকখালী ইউনিয়ের পূর্ব বাদুরগাছা গ্রামে। শুধু তাই নয়, ঘটনা যাতে প্রকাশ করা না হয় সেজন্য ওই দিনমজুর পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয়। থানায় মামলা করলে তাদের এলাকাছাড়া করারও হুমকি দেওয়া হয়। পরিবারটিকে অবরুদ্ধ করে রাখারও সংবাদ পাওয়া গেছে।
খবর ২. টেস্টিং কিট ছাড়েও ঘুষ
দৈনিক যুগান্তরের একটি সংবাদের শিরোনাম: ‘করোনা প্রতিরোধে ঢাকা কাস্টমস উদাসীন, বিমানবন্দরে আটকে আছে টেস্টিং কিট পিপিই, ১৫ দিনেও ছাড় করা যাচ্ছে না জরুরি এসব পণ্য।’ বিস্তারিত খবরে বলা হয়: সরকারকে সহায়তা করতে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আনা করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট ও পিপিইসহ বিভিন্ন সামগ্রী খালাসে অহেতুক হয়রানি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো কিছু খালাস করা কঠিন। পণ্য খালাসে আইনগত ফাঁকফোকর তালাশে ব্যস্ত কর্মকর্তারা। যেসব কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট সময় লাগার কথা, সেখানে তারা ৩-৪ দিন পার করছেন। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা এবং অ্যাসেসমেন্ট গ্রুপের সহকারী ও উপকমিশনাররা ফ্রি স্টাইলে সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে ঘুষ দাবি করছেন। অবশ্য এই ঘুষ তারা নিজের হাতে নেন না। প্রত্যেক অফিসারের অধীনে ‘ফালতু’ নামে বিশেষ আদায়কারী আছে। যারা বহিরাগত দালাল। তারাই কর্মকর্তাদের পক্ষে ঘুষের রেট ঠিক করেন। কিন্তু চাহিদামতো ঘুষ না পেলে পণ্যের এইচএস কোড পরিবর্তনসহ নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করা হয়।’
খবর ৩. করোনা রোগীর চেয়ে চাল চোর বেশি
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের কারণে বেকার হয়ে পড়া মানুষদের খাদ্য সহায়তার জন্য সরকার সারা দেশে বিনামূল্যে ও খোলা বাজারে সুলভমূল্যে যে চাল বিতরণ করছে, তা চুরির মহোৎসব শুরু হয়েছে। যেদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেশে করোনায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা জানালো ১৬৭ জন, সেদিন অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়া রসিকতা করে লিখেছেন: ‘দেশে করোনায় আক্রান্ত ১৬৭, আর চাল চোর ধরা পড়েছে ২০৬ জন’। কেউ কেউ লিখেছেন, ‘এ দেশে কাফনের কাপড় বিতরণ করতে দিলেও কিছু লোক চুরি করবে’। মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হলে এসব কথা লিখতে পারে! তবে শুধু চাল চুরি করাই শেষ কথা নয়, এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ভোলায় এক সাংবাদিক নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জেও নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের কথা তুলে ধরায় দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের প্রতিনিধি ও নবীগঞ্জ সাংবাদিক ফোরামের সাবেক সভাপতি শাহ সুলতান আহমেদের ওপর হামলা হয়েছে।
আজ শুক্রবার কালের কণ্ঠর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ দিনে দেশের বিভিন্নস্থানে অন্তত ২ হাজার ২৬৪ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় ৫৫০ বস্তা, বগুড়ায় ১০০ বস্তা, নাটোরে ১৩ বস্তা, জয়পুরহাটে ৭ বস্তা, যশোর ৮০ বস্তা, যশোরের মণিরামপুরে ৫৫৫ বস্তা, ঝিকরগাছায় ১ বস্তা, নওগাঁয় ৩৩৮ বস্তা, বাগেরহাটে ১৮ বস্তা, পটুয়াখালীতে ১০ বস্তা, ঝালকাঠিতে ৫০ বস্তা, সিলেটে ১২৫ বস্তা, ময়মনসিংহের ত্রিশালে ১৬ বস্তা, সারিয়াকান্দি উপজেলায় ২৮৮ বস্তা, গাবতলী উপজেলায় ১০০ বস্তা, বগুড়ার শিবগঞ্জে ১৩ বস্তা। এসব ঘটনায় অভিযুক্ত ও আটকদের অধিকাংশই জনপ্রতিনিধি অথবা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা।
বরগুনার পাথরঘাটায় ইলিশ সুরক্ষায় মাছ ধরা বন্ধ রাখা জেলেদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের অভিযোগে কাকচিড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন পল্টুকে আটক করা হয়। নৌবাহিনী ও বরগুনা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে কাকচিড়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাকে আটক করে। পল্টু তার এলাকার সাড়ে পাঁচশ জেলের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ৪৪ মেট্রিক টন চাল পাথরঘাটা খাদ্য গুদাম থেকে ছাড়িয়ে আনেন। মেম্বারদের না জানিয়ে বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে তার একান্ত কিছু জেলেদের মধ্যে ১৪ মোট্রিকটন চাল বিতরণ করে ৩০ মোট্রিকটন আত্মসাৎ করেন। তিনি অপরাধ স্বীকার করে বলেছেন, ‘এ ধরনের অন্যায় আর কখনো করব না’। তিনি সব চাল ফেরত দিয়ে দেবেন বলেও স্বীকার করেন।
এর বাইরে ঢাকা উত্তর সিটির এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তিনি স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সম্পদশালীদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও সমপরিমাণ ত্রাণ দেননি। ঘরবন্দি নিম্নআয়ের বেশিরভাগ মানুষই কোনো সহায়তা পাননি। আর যারা ত্রাণ পেয়েছেন তারা সবাই কাউন্সিলরের লোক বলে পরিচিতি।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় এক সাবেক এমপি কাউন্সিলর ফোরকানকে দিয়েছেন দুই লাখ টাকা। সিটি করপোরেশন থেকে পেয়েছেন সাড়ে লাখ লাখ টাকা। এছাড়াও ত্রাণের কথা বলে চাঁদা তুলেছেন তিনি ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। অথচ এলাকার বেশির ভাগ দরিদ্র মানুষের দাবি, গত ১৩ দিনেও কেউ যাননি তাদের খোঁজ নিতে। দেননি কোনো খাদ্য সহায়তা। উত্তর সিটির আরেকটি ওয়ার্ডের সংবাদে বলা হচ্ছে, সাধারণ ছুটিতে কর্মহীন হয়ে পড়াদের মধ্যে কেবল স্থানীয় ভোটাররা পাচ্ছেন ত্রাণ। যাদের ভোট বাইরে তারা ঢাকায় অবস্থান করেও ত্রাণ পাচ্ছেন না। অথচ এই ওয়ার্ডে দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি।
খবর ৪. ছবি তুলে কেড়ে নিলেন ত্রাণ
বাংলাদেশে কাজ করার চেয়ে কাজ দেখানোর প্রবণতা বেশি। দশজনকে ত্রাণ দেওয়ার জন্য ১০০ লোকের এলাহি আয়োজন, ফটোসেশন ও তারপর সেই ছবি গণমাধ্যম-সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশের উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। জাকাতের কাপড় দেওয়ার নামে এলাকায় মাইকিং এবং তারপর পদদলিত হয়ে শত শত মানুষের মৃত্যুও নতুন কোনো সংবাদ শিরোনাম নয়। তবে এবার সেসব কিছুকে ছাপিয়ে গেলো একটা অন্যরকম খবর। তা হলো, করোনাভাইরাসের কারণে কর্মহীন মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের নামে লোকজন জড়ো করে ছবি তুলেই তাদের পিটিয়ে তাড়ানোর অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত নুরুল আবছার হাটহাজারী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা।
সংবাদে বলা হচ্ছে, ‘উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাটহাজারীর সব ইউনিয়ন পরিষদে চাল ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন ইউনিয়নে এসব চাল বিতরণ করা হলেও মির্জাপুর ইউনিয়নে তা হয়নি।
গতকাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলাকায় আসবেন জেনে তড়িঘড়ি করে মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আবছার মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণের নামে লোকজন জড়ো করেন। কিন্তু ইউএনও পরিদর্শন করে চলে যেতেই ত্রাণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় চেয়ারম্যানের লোকজন। এর প্রতিবাদ করলে চেয়ারম্যান ও তার অনুসারীরা চড়াও হন অসহায় লোকজনের ওপর। এমনকী, তাদের পেটানোও হয়।’
খবর ৫. অতি উৎসাহের লকডাউন ও পিটুনি
সাধারণ ছুটি নাকি লকডাউন— এই বিভ্রান্তিতে এরইমধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। সরকারের ঘোষণায় বলা হয়েছে সাধারণ ছুটি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা লকডাউন কার্যকরে। শুরু থেকেই নানা মহলের দাবি ছিল পুরো দেশ দুই সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ লকডাউন করা। দেরিতে হলেও সরকার সেই পথে হেঁটেছে। কিন্তু, ঘোষণা করা হলো সাধারণ ছুটি এবং সঙ্গত কারণেই লাখ লাখ মানুষ রাজধানী ছেড়ে যেন পালাতে চাইলো।
এরপর ছুটির মেয়াদ শেষ না হতেই হাজার হাজার পোশাক শ্রমিককে ঢাকায় আনা হলো। অথচ করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রধান উপায়ই হচ্ছে শারীরিক দূরত্ব। কিন্তু একের এর এক ভুল আর বিলম্বিত সিদ্ধান্ত দেশের মানুষকে একটার পর একটা ঝুঁকিতে ফেলেছে।
একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর লোকের মনে এ নিয়ে কোনো ভয়ভীতিও প্রবেশ করেনি। যে কারণে তারা লকডাউন না মেনে বাইরে বের হতে থাকে। রাজধানী ও বড় শহরগুলোয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা যতটা চোখে পড়ে, সঙ্গত কারণে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র এই তৎপরতা দেখানোর মতো লোকবলও তাদের নেই। যে কারণে তৈরি হয়েছে কিছু অতি উৎসাহী গ্রুপ— যারা লকডাউন কার্যকর তথা মানুষকে ঘরে রাখতে নিজেরাই বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়েছে এবং কোথাও কোথাও লাঠি হাতে লোকজনকে মারধর করতেও দেখা গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ মানুষ এভাবে ব্যারিকেড দেওয়া বা লোকজনকে মারধর করতে পারেন কিনা? যদি পারেন তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কী কাজ? এ জাতীয় কাজের বৈধতা দেওয়ার মানে হলো, ওই উৎসাহী লোকজন নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলীয় শত্রুতা মিটানোর জন্যও মারধর শুরু করতে পারেন। তাছাড়াও, অনেক স্থানে এমনভাবে ব্যারিকেড দেওয়ার খবর এসেছে যে, সেখানে জরুরি প্রয়োজনে মানুষের চলাচলও ব্যাহত হয়েছে।
সুতরাং, একদিকে করোনা ঠেকানোর লড়াই, অন্যদিকে এই অতি উৎসাহী লোকজনের আচরণ— সবকিছুই সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে।
পরিশেষে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজর রাখলে দেখা যাবে, অনেকেই করোনাউত্তর এক নতুন পৃথিবী ও নতুন বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশী। সেই প্রত্যাশা নিশ্চয়ই আমাদের সবারই। কিন্তু, এই চরম বিপদের মধ্যেও যেসব ঘটনা আমাদেরই ভাই-বন্ধু-পরিজনরা ঘটাচ্ছেন; মানুষের এই চরম দুঃসময়কে পুঁজি করেও যারা চুরি-ঘুষ আর ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারছেন না, সেসব লোকের দেশে শেষ পর্যন্ত আসলে কতটুকু পরিবর্তন আসবে?
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।
Comments