করোনা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন দেড় লাখের বেশি চা শ্রমিক

স্টার ফাইল ছবি

সারাদেশের চা-বাগানে প্রায় দেড় লাখের বেশি চা শ্রমিক কাজ করেন। করোনা মহামারি মোকাবিলায় দেশে এখন সাধারণ ছুটি চলছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ রপ্তানিমুখী সব শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। কিন্তু, ছুটি পাননি চা শ্রমিকরা। তাই বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চা-বাগানে কাজ করছেন এসব শ্রমিক। অনেক শ্রমিক সংগঠন এজন্য চা শ্রমিক নেতাদের অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন।

গত ৪ এপ্রিল মৌলভীবাজারের রাজনগরের একটি চা-বাগানের পাশে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক দোকানির মৃত্যু হয়। পরে নমুনা পরীক্ষায় তিনি করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন। ওই দোকানির সঙ্গে চা শ্রমিকদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই। ফলে, শ্রমিকদের মধ্যে করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

রাজনগরের পাশেই সনাতলা চা-বাগান। গত ৮ এপ্রিল কমলগঞ্জের রহিমপুরে ১৩ বছরের শিশু করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায়। মৃত শিশু ও তার মায়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পেলে তাদের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এসব কারণে চা শ্রমিকরা আতঙ্কিত এবং তারা করোনা ঝুঁকিতে আছেন। স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও বেতন কাটার ভয়ে অনেকে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে, গত ৭ এপ্রিল চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত ও পরাজিত প্যানেল সম্মিলিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় সব বাগানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হবে এবং পঞ্চায়েতের পক্ষ মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।

ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গা থেকে কাজ করতে আসা চা শ্রমিকদের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা চম্পারায় চা-বাগানের এক শ্রমিকের নমুনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে।

খেজুরী চা-বাগানের শ্রমিক রসরাজ বাউরি বলেন, ‘একজন শ্রমিক আক্রান্ত হলে তা অনেক শ্রমিকের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য মজুরিসহ সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও সরকারি বরাদ্দের দাবি জানাই। অচিরেই বেতন-ভাতা দিয়ে আমাদের ছুটি মঞ্জুর করা হোক। আমরাও বাঁচতে চাই। গার্মেন্টস শ্রমিকরাও ছুটি পেলেও আমরা পাই না। চা শ্রমিক নেতাদের কারণে আজ আমরা বিভিন্ন সুযোগ থেকে বঞ্চিত।’

কুলাউড়ার মুরইছড়া চা-বাগানের মুনিয়া উরাং বলেন, ‘চা পাতা সংগ্রহকারী নারীরা দলে দলে কাজ করেন। শ্রম আইনে বলা থাকলেও আমাদের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক শ্রমিককে একই গ্লাসে পানি পান করতে হয়। অনেকে হাতের মুঠোয় ভরেও পানি পান করেন। ভাইরাস ছড়াতে এর থেকে বিপজ্জনক আর কী হতে পারে?’

ইসলামপুরের স্বাস্থ্যকর্মী মহেশ রজত বলেন, ‘ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের নামের তালিকা তৈরি করে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে দিয়েছি। তিনি চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’

ইসলামপুরের ইউপি রাজেশ নুনিয়া বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক জন কয়েকদিন ধরে জ্বর ও কাশিতে ভুগছে। তাকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া, বহিরাগত লোকদের বাগানে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এখানের ঘন বসতির মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়লে বাগানে মহামারি দেখা দেবে।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আবুল হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার অবস্থা খুবই নাজুক। এ ছাড়াও, প্রথম থেকেই বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের পরিচ্ছন্ন কোন বক্তব্য নেই। যখন পরিস্থিতি সংকটময় হয়ে উঠেছে ঠিক তখন ইউনিয়নের নেতারা ছোট কিছু প্রোগ্রাম দিয়ে গোঁজামিল দিতে চাইছেন। তারা সবসময় মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকে।’

কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মুহম্মদ মাহবুবুল আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘গত ৮ এপ্রিল কালেঙ্গায় একটি শিশু মারা গেলে তার ও তার মায়ের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। শিশুটি আগে থেকেই নিউমোনিয়া আক্রান্ত ছিল। চম্পারায় চা-বাগান থেকে নারায়ণগঞ্জ ফেরত শ্রমিকেরও নমুনা সংগ্রহ করে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস বলেন, ‘চা জীবনরক্ষাকারী কোনো পণ্য নয়। এখন চা পাতার কোনো সিজন নেই। তাই ঝুকি ছাড়াই মালিক পক্ষ চা শ্রমিকদের বেতন দিয়ে ছুটি দিতে পারেন। কিন্তু, সবকিছুর অন্তরায় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। তারা সবসময় মালিক পক্ষের দালালের ভূমিকা পালন করে।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, ‘রপ্তানিমুখী সকল শিল্প প্রতিষ্টানসহ সরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলেও অবহেলিত চা শ্রমিকরা। দেশের সব চা বাগানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করছে। অথচ মালিক বা সরকার বাগান বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।’

সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কথা মতো শ্রমিকরা বাগানে কাজ করছে। তবে অনেক চা-বাগান শ্রমিকদের নিরাপদ দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখছে না। তারা শ্রমিকদের হাত ধোয়ার সাবান ও মাস্ক দেয়নি। তাই এসব শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।’

বাংলাদেশ চা-সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বলেন, ‘চা-বাগানে এখন পর্যন্ত কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। করোনার সংক্রমণ রোধে আগে থেকেই বাগানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শ্রমিকদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলা হয়েছে। তাদের মাস্ক-সাবান দেওয়া হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করতে বলা হয়েছে। শ্রমিকেরা তা মেনেও চলছেন। চায়ের ব্যবসা এমনিতেই খারাপ। ছুটি দিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রভাব শ্রমিকদের ওপরও পড়বে। সরকারও  চা বাগানে ছুটি ঘোষণার কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’

 

 

Comments

The Daily Star  | English
price hike of essential commodities in Bangladesh

Essential commodities: Price spiral hits fixed-income families hard

Supply chain experts and consumer rights activists blame the absence of consistent market monitoring, dwindling supply of winter vegetables, and the end of VAT exemptions granted during Ramadan.

14h ago