এটা হেলথ ইমার্জেন্সি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় নয়

বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের একদম সামনের সারিতে আছেন চিকিৎসকরা। নেতৃত্বে যেমন আছেন, পরিকল্পনায় এবং সরাসরি হাসপাতালে চিকিৎসাতেও তারাই আছেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা কিন্তু তারাই করছেন।
ছবি: ফিরোজ আহমেদ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বৃদ্ধি এবং তার চিকিৎসা নিয়ে হিমসিম খাওয়া এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ছয় জন চিকিৎসককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে রাজি হননি। এটি কর্তৃপক্ষীয় ভাষ্য। চিকিৎসকদের ভাষ্য কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। যদিও ভালো সাংবাদিকতায় অভিযুক্তদের বক্তব্য থাকার বাধ্যবাধকতা আছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সারা বিশ্ব যখন হিমসিম খাচ্ছে তখন কোনো চিকিৎসক যদি রোগীদের সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানান সেটি মারাত্মক অন্যায়। স্বাভাবিক সময়েও কোনো চিকিৎসক তা করতে পারেন না। এই চিকিৎসকরা আগে থেকে সেবা দিচ্ছিলেন এখন সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, না কি একদমই সেবা দিতে রাজি হননি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তা পরিষ্কার নয়।

করোনাভাইরাসের বিস্তারের শুরু থেকেই ‘ডাক্তাররা রোগী দেখছেন না’  ‘হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করছে না’ এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুর খবরও আমরা পরেছি। সেই ঘটনাগুলোয় সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। কোনো একটি ঘটনায় তদন্ত হয়েছে বা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়াও দেখানো হয়নি। ‘কেন চিকিৎসকরা রোগী দেখতে চান না, তাদের সমস্যা কী’—সেগুলো নিয়ে সরকারের কোনো পর্যায় থেকে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে—এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। বরং প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে চিকিৎসক—নার্স আমদানির কথাও তিনি বলেছেন।

বর্তমানের বাস্তবতায় বিদেশ থেকে চিকিৎসক-নার্স আনার ব্যাপারটা যে একটি অসম্ভব কল্পনা সেটি সচেতন প্রতিটি নাগরিই বুঝতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এখন চিকিৎসাসেবীদের কি সংকট চলছে। বিভিন্ন দেশের সরকার এখন অনুরোধ করে, বেশি বেতন দিয়ে অবসরে যাওয়া স্বাস্থ্যসেবীদের কাজে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ‘মানুষ বাঁচানোর আকুতি নিয়ে খোদ রাষ্ট্র অবসরে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে যারা বিদেশ থেকে চিকিৎসক-নার্স আনার ঘোষণা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তারা সরকারের তো নয়ই, দেশেরও শুভাকাঙ্ক্ষী নন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়াটি যারা তৈরি করেছেন তারা হয় তো চিকিৎসকদের প্রতি তাদের নিজেদের ক্ষোভটা প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়ে প্রকাশ করিয়ে নিয়েছেন।

একটা বিষয় সবারই পরিষ্কারভাবে বোঝা দরকার, সারা বিশ্বে এখন হেলথ ইমার্জেন্সি চলছে। বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ কিন্তু বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছে না, বা কোনো রাজনৈতিক সংকটও নয়। বিশ্বের  প্রতিটি দেশেই এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের একদম সামনের সারিতে আছেন চিকিৎসকরা। নেতৃত্বে যেমন আছেন, পরিকল্পনায় এবং সরাসরি হাসপাতালে চিকিৎসাতেও তারাই আছেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা কিন্তু তারাই করছেন।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কোথায় লকডাউন হবে, কত দিনের লকডাউন হবে, কোথায় ট্রেনিং বাড়াতে হবে, এইসব নির্দেশনা কিন্তু দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। রাজনৈতিক সরকার চিকিৎসকদের পরামর্শ এবং নির্দেশনা অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীরাও চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের আমরা অতটা আশা করি না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এই ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। দেশে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক থাকলেও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় তাদের ভূমিকা কোথাও নেই। ক্রান্তিকালেও রাষ্ট্র তাদের পরামর্শ নেয় না। ফলে প্রশাসন দিয়েই বর্তমানের হেলথ  ইমার্জেন্সি মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। আর আমাদের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা হেলথ ইমার্জেন্সিকে তাদের বন্যা ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার অভিজ্ঞতার আলোকে সমাধানের চেষ্টা করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন বিভাগ, জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। সেখানে জেলার, বিভাগের চিকিৎসকরা আছেন তিন চার নম্বরে। অথচ একটা হেলথ ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসকদের সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা করার কথা, তাদেরই এই ধরনের কনফারেন্সের নেতৃত্বে থাকার কথা। নেতৃত্বের কথা না হয় বাদই দিলাম। যে চিকিৎসকরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে হাসপাতালে মানুষ বাঁচানোর কাজে নামবেন, তাদের সঙ্গে রাষ্ট্র কি ভালো ব্যবহারও করবে না! তাদের সমস্যার কথাগুলো শুনবে না? তাদের কী প্রয়োজন—সেগুলোর যোগান দেয়ার উদ্যোগ নেবে না?

পুরো বিশ্বই এখন একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। সম্মিলিতভাবে ‘টিম বাংলাদেশ’ হিসেবেই এই সংকট মোকাবিলা করতে হবে। আর এই সংকটটা যেহেতু হেলথ ইমার্জেন্সি—দেশের চিকিৎসকদেরই এই সংকট মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। কাজেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে এই ফ্রন্টলাইনারদের আস্থায় নিয়ে আসা, তাদের প্রয়োজনীয় সমর্থন দেওয়। সমস্যার সমাধান না করে চাকরিচ্যুতি, বরখাস্তের মাধ্যমে চিকিৎসকদের মনে আতঙ্ক তৈরি করা যাবে, কিন্তু তার ফলটা ভালো হবে না। এটা হেলথ ইমার্জেন্সি, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় নয়—এইটুকু বিবেচনায় নিলেই অনেক পদক্ষেপ সহজ হয়ে যায়। আশা করি সরকার সেভাবেই ভাববেন।

শওগাত আলী সাগর: কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’র প্রধান সম্পাদক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

People want a party helmed by the youth

Forming an alternative political force and ensuring transparency in government work were the two issues that figured most prominently in the district-level views-exchange meetings organised by the Anti-Discrimination Students Movement.

14h ago