রামেক হাসপাতালে পড়ে আছে করোনা পরীক্ষার মেশিন
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় নমুনা পরীক্ষার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) ল্যাবরেটরিতে পিসিআর মেশিন স্থাপন করে সরকার। একটি মেশিনে পুরো বিভাগের ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে সংশ্লিষ্টরা হিমসিম খেলেও অনুমতি না পাওয়ায় রামেক হাসপাতালে একটি রিয়েল টাইম পলিমেরাস চেইন রিঅ্যাকশন মেশিন গত চার বছর ধরে অব্যবহৃত পড়ে আছে।
রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, দক্ষ জনবল ও উপযুক্ত জায়গার অভাবে এত দিন মেশিনটি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ গত চার বছরে কয়েকবার চেয়েও মেশিনটি ব্যবহারের অনুমতি পায়নি। এর পেছনে ছিল হাসপাতালের কর্মকর্তাদের অবহেলা ও উদাসীনতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এত বড় হাসপাতালে এই মেশিনটি স্থাপনার জায়গা হবে না, এ কথা ঠিক না।’
মার্চের শেষে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে করোনা পরীক্ষার জন্য একটি আরটি পিসিআর মেশিন স্থাপন করে। এটি ছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা পরীক্ষাগার ছড়িয়ে দেওয়ার সরকারি প্রক্রিয়ার অংশ। গত ১ এপ্রিল রামেকের ভাইরোলজি বিভাগ করোনা ল্যাব তৈরি করে ওই মেশিনে বিভাগের আটটি জেলা থেকে আসা নমুনা পরীক্ষা শুরু করে।
রামেক সূত্র জানায়, ২০১৭ সালেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি আরটি পিসিআর মেশিন পাঠিয়েছিল। তখন উদ্দেশ্য ছিল, এই মেশিন মানবদেহে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের আক্রমণ শনাক্তে ব্যবহৃত হবে। ২০১৮ সালের মে মাসে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেশিনটি স্টোর থেকে আউটডোর প্যাথলজি বিভাগে স্থানান্তর করে। মেশিন স্থাপনের জন্য একটি ঘরও দেওয়া হয়। তবে অনুমতি না পাওয়ায় মেশিনটি প্যাকেট থেকে খোলাই হয়নি।
হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘মেশিনটি ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা আমাদের ছিল না। প্যাথলজিতে পর্যাপ্ত জায়গাও ছিল না। যেহেতু সংক্রামক রোগের নমুনা নিয়ে কাজ করা হয়, তাই এই মেশিনে কাজ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এটা ব্যবহারের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়। প্যাথলজিতে যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসার প্রয়োজনে ভিড় করে, সেখানে এমন একটি মেশিন ব্যবহার করা সমীচিন হতো না।’
যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ভাইরাসবিদ্যা বা জীবাণুবিজ্ঞানের মতো কোনো বিভাগ না থাকা সত্ত্বেও কী করে একটি হাসপাতালে এ রকম মেশিন থাকতে পারে! আমি কাগজপত্র খুঁজে দেখব।’
‘প্রশিক্ষিত ভাইরোলজিস্ট বা মাইক্রোবাইয়োলজিস্টরাই কেবল এই মেশিনটি ব্যবহার করতে পারেন। এটি ব্যবহারের প্রক্রিয়া খুব জটিল, অসতর্কতায় সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে,’ বলেন ডা. নাসিমা সুলতানা।
রামেকের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ‘আরটি পিসিআর মেশিন স্থাপনের জন্য কমপক্ষে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি পৃথক জায়গা দরকার হয়। সেখানে চারটি বিশেষভাবে তৈরি ঘর থাকতে হবে।’
তারা জানান, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে মেশিনটি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। অনুমতি পেলে শিক্ষার্থীরা গবেষণার কাজে যেমন ব্যবহার করতে পারতো, রোগ নির্ণয়েও কাজে লাগানো যেত। কিন্তু রামেক হাসপাতাল বরাবরই না সূচক উত্তর দিয়েছে।
ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাবেরা গুলনাহার বলেন, ‘গত সপ্তাহে যখন আমরা নতুন মেশিনটি নিয়ে ব্যস্ত, তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের পড়ে থাকা মেশিনটি ব্যবহারের জন্য আরেকটি পত্র দেয়। আমরা নতুন মেশিনে সব জনশক্তি নিয়োগ করেছি, এই অবস্থায় কীভাবে আরও একটি মেশিনের দায়িত্ব নেব?’
সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি জানি না কেন রামেককে আগে মেশিনটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে রামেক হাসপাতালের পরিচালকের সরকারি মোবাইলে অন্তত ছয়বার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।
ডা. সাবেরা গুলনাহারকে নতুন করোনা ল্যাবরেটরির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শুরুর দিকে স্যাম্পল কম এলেও, এখন নমুনা পরীক্ষার চাপ বেড়ে গেছে।
গত ১২ এপ্রিল পর্যন্ত তারা ৪৮১টি নমুনা পরীক্ষা করেছেন। তখনও তাদের হাতে আরও ১৫০টি নমুনা ছিল। তিনি বলেন, ‘ল্যাবের মোট ৪০ জন স্টাফের ১৮ জনই মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও বায়োকেমিস্ট ও ১২ জন টেকনিশিয়ান।’
ল্যাবের আরটি পিসিআর মেশিনে প্রতি ছয় ঘণ্টায় ৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হলেও, তারা এক দিনে একবারের বেশি মেশিনটি চালাতে পারেন না।
‘কারণ সেখানে যারা পিপিই পরে এক নাগাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করেন, তারা ওই দিনে আর কোনো কাজ করতে পারেন না। এ কাজে সব সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ না থাকলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে,’ বলেন ডা. সাবেরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে মোট ২৮টি আরটি পিসিআর মেশিন আছে। ১৮টি ঢাকায় ও ১০টি ঢাকার বাইরে। সবগুলো মেশিন এখন করোনা পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলায় নতুন একটি আরটি পিসিআর মেশিন স্থাপনে কাজ শুরু করেছে। সেটি চালু হলে রামেক ল্যাবের ওপর চাপ কিছুটা কমে আসবে।
Comments