প্রস্তুতির ঘাটতিই ‘বিরাট সংকট’

বাংলাদেশের মানুষের জন্য আপাতত কোনো ভালো খবর নেই। খারাপ খবরের মধ্যে আরও খরাপ খবর হলো করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল দেশে প্রথম একজন চিকিৎসক মৃতু বরণ করেছেন। 

আইইডিসিআর’র এর চার কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তারা সবাই কভিড-১৯ টেস্ট কাজে জড়িত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরারও করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়েছে। তার রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ হলেও তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

সরকারি তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ১০ জন, নতুন করে আক্রান্ত সনাক্ত হয়েছেন ৩৪১ জন। করোনায় এই পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬০ জন। আজ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৫৭২ জন। মাত্র ১৭০০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে এই সংখ্যা পাওয়া গেছে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন মাত্র ৪৯ জন, যা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রোগীর থেকেও ১১ জন কম। (তথ্যসূত্র- corona.gov.bd)

গত সাত দিনে দেশে এক হাজার কোভিড-১৯ রোগী হয়েছে। আজকের তথ্য মতে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন।

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে ৫৪ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হওয়ার কথা গতকাল সংবাদিকদের জানিয়েছে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন। চিকিৎসা সেবার সঙ্গে জড়িত মোট শতাধিক মানুষ কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছেন। আজকেও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অনেকের আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

এখন দেখা যাক, বাংলাদেশ সরকার করোনা মোকাবিলায় কেমন দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। ডিজি হেলথ এর দেওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দেশে করোনা রোগীদের জন্য আইসিউ বেডের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এখন প্রশ্ন হলো, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ডাক্তার, নার্সরা কি তাদের প্রয়োজনে আইসিউ বেড পাবেন?

দেশে যদি আগামী এক মাসে আরও ১০০ জন ডাক্তার, নার্স, করোনা আক্রান্ত হন, আর তাদের একটা অংশের আইসিউ প্রয়োজন হয়; তবে সরকার কি তার ব্যবস্থা করতে পারবে?

করোনায় ধস নামা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বাংলাদেশ সরকার ৭২,৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদণা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। ডাক্তারদের জন্য অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা সম্মানী ঘোষণা করেছে। কৃষকদের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার সহজ ঋণ স্কিম ঘোষণা করেছে।

এখন কথা হলো, এত কিছু সরকার এত পরে ঘোষণা করছে কেন? সরকার যদি সঠিক সময়ে করোনা মোকাবিলার সব প্রস্তুতি নিত তাহলে কি এত টাকার প্রয়োজন হতো? যদি আক্রান্ত ডাক্তার, নার্সরা ডাক্তার সঠিক চিকিৎসা না পান, যদি চিকিত্সা সেবা দিতে গিয়ে নিজেদের নিরাপদ না মনে করতে পারেন, যদি সাধারণ মানুষ করোনার নমুনা পরীক্ষা না করতে পারেন, যদি চিকিত্সার অভাবে মানুষ বাড়িতে বা রাস্তায় মরে পড়ে থাকেন তাহলে এত টাকা দিয়ে কী হবে?

বগুড়া ২৫০ শয্যার মোহাম্মদ আলী হাসপাতালকে করোনা হাসপাতাল ঘোষণা করা হয় ২৪ মার্চ এবং করোনা রোগী ভর্তি করা হয় ২৯ মার্চ থেকে। সেখানে এখন রোগীর সংখ্যা ছয় জন, এর মধ্যে একজন করোনা পজিটিভ। 

এই হাসপাতালে কোনো আইসিউ বেড ছিল না। সরকার সেখানে কয়েকদিন আগে সাতটি আইসিউ বেড এবং আটটি ভেন্টিলেটর দিয়েছে কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ থেকে দুইটি আইসিউ বেড ধার করে আনা হয়েছে। ছোট অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে ভেন্টিলেটর মেশিনগুলো চালানো যায় মাত্র ২০ মিনিট। অক্সিজেন সিলিন্ডার পাল্টানোর সময় রোগীর সমস্যা হয় বলে জানিয়েছেন একজন চিকিত্সক। 

করোনার জন্য নির্ধারিত এই হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে পিপিই দেওয়া হয়েছে এ পর্যন্ত ১,৮০০। এগুলোর মান নিয়ে এখানকার চিকিৎসকদেরই সন্দেহ রয়েছে। এন৯৫ মাস্কগুলোও মানসম্মত নয় বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিত্সক জানান, আগে কিছু মানসম্পন্ন পিপিই পাওয়া গেলেও এখন যেগুলো দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর মান ভালো নয়। ডাক্তাররা এগুলো পরে চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছেন। শুধু মনের ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে সেবা দিচ্ছেন ডাক্তাররা।

করোনায় আক্রান্ত দেশের প্রথম চিকিত্সকের মৃতুরে বিষয়ে দুঃখ করে একজন ডাক্তার বলেন, সিলেটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে যওয়ার জন্য যে এম্বুলেন্স চেয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের জটিলতায় তিনি তা পাননি। একই কথা জানিয়েছেন সিলেটের একজন সাংবাদিক বন্ধু। তার পরিবারের দাবি ছিল, একটি আইসিউ অ্যাম্বুলেন্সের। অথচ সিলেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরেও সরকারি কোনো আইসিউ এম্বুলেন্স নাকি নেই। ডাক্তারাই যদি না বাঁচেন তবে তারা চিকিত্সা দেবেন কীভাবে?

দেশের কোন শ্রেণির মানুষই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। চিকিত্সকরা তো নয়ই। চিকিত্সা দিতে অনাগ্রহের অভিযোগে কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপালের ছয় জন চিকিৎসককে বরখাস্ত করেছে সাস্থ্য বিভাগ। চিকিৎসকদের সুরক্ষিত না করে তাদের কাছে সেবা আশা করা কতটা যোক্তিক সেটা কি সরকার বা আমরা সাধারণ মানুষ ভাবছি?

দিনে হাজার হাজার মানুষ করোনা পরীক্ষার অনুরোধ জানিয়ে ফোন করছেন আইইডিসিআরের হটলাইনসহ দেশের সমস্ত হাসপাতালে। চিকিত্সা না পেয়ে কত রোগী স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ফিরে আসছেন। চিকিত্সা না পেয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করেছেন গাইবান্ধার এক নারী। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। প্রতিদিন চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ মারা যাওয়ার খবর উঠে আসছে গণমাধ্যমগুলোতে।

অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক গতকাল বলেছেন, ‘অনেকে পরীক্ষা করতে চান না, পরীক্ষা থেকে দূরে থাকেন। এটা একটা বিরাট সংকট।’ আসলে সংকট কী? কোথায় তৈরি হচ্ছে সেই বিষয় কি খুলে বলবেন মন্ত্রী সাহেব? অনেক পরীক্ষা করতে চাইবেন না কেন? নিজেদের দোষ-ত্রটি ঢাকার জন্য এমন নির্জলা অজুহাত দিলেই কি সব দোষ চাপা পড়ে যাবে?

মন্ত্রী মহাশায়ের কাছে প্রশ্ন, চীনে যখন যখন হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল, দেশের পর দেশ আক্রান্ত হচ্ছিল, তখন আপনারা কী করছিলেন? অথচ বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা করোনাকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করেছে অনেক আগেই।

৮ মার্চের পর থকে সরকার দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজ পর্যন্ত ২০টি ল্যাব চালু করেছে নমুনা পরীক্ষার জন্য। আগে থকে প্রস্তুতি নিলে এরকম আরও ১০০ টি ল্যাব স্থাপন করা সম্ভব হতো। প্রতিটি জেলায় নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। আজ  পর্যন্ত ২০০০ এর বেশি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিলে দিনে এক লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হতো এত দিনে। এতে করে করোনা সংক্রমণ অনেকটা রোধ করা যেত। দিনে ২০০০ নমুনা পরীক্ষা করে যদি শ তিনেক রোগী শনাক্ত করা যায়, তবে দিনে এক লক্ষ নমুনা পরীক্ষা করলে আরও অনেক রোগী পাওয়া যেত, তাতে করে সংক্রমণের হার অনেকাংশে কমানো যেত। মানুষের মাঝে তাই সরকারের প্রতি বিশ্বাস এখন শূন্যের কোঠায়।

দিনে দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে দিগুণ হারে। জরুরি সেবার সঙ্গে যুক্ত সব শ্রেণির মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। ডাক্তার নার্স, সাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক সবার মধ্যে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। ৩১টির বেশি জেলা লকডাউন করা হয়েছে কিন্তু সামাল দিতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। স্থল এবং জল পথে হাজারো মানুষ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকে তাদের গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে গিজ গিজ করছে মানুষ। জেলায় জেলায় কর্মহীন-অনাহারী মানুষ ত্রাণের জন্য রাস্তায় মিছিল করছেন। কৃষকরা তাদের ফসল নিয়ে হাহাকার করছেন।

প্রধানমন্ত্রী দুস্থদের জন্য সবকিছু করার চেষ্টা করছেন অথচ হাজার টন সরকারি ত্রাণ আত্মসাতের অভিযোগের কথা উঠছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।

মানুষ আধুনিক রাষ্ট্রের জন্মই দিয়েছিল নিজেদের যান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। নেতাদর ভোগ-বিলাসের জন্য মানুষ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়নি। যেকোনো যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা মহামারিতে রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হলো, জনগণের প্রাণ ও সম্পদের হেফাজত করা। সেই কাজে রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সব কিছুর ওপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যায়। সমাজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। এমন অবস্থাকে ব্যবস্থাকে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন এনোমিক সোসাইটি (Anomie)। এমন অবস্থায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

মহামারিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ২০ লাখ ছাড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২৮ হাজারের বেশি। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, বিশ্বের ১৮৫টি দেশে আঘাত হেনেছে এই মারণ ব্যধি। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিশ্বের অন্য রাষ্ট্রগুলো কিভাবে করোনা মোকাবিলা করছে তা অনুসরণ করা।

সরকার দাবি করছে, এই মহামারী মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি তাদের আছে। সরকারের তহবিলে আছে যথেষ্ট টাকা এবং ত্রাণ ভান্ডারে আছে যথেষ্ট খাদ্যশস্য। কিন্তু এই ত্রাণ তো অনাহারী মানুষ সঠিকভাবে পাচ্ছে না। সরকারের ত্রাণ নিয়ে কি ঘটছে? সরকার দলীয় নেতারা  ত্রাণ চুরি করে করোনা কালে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। সামাজিক দূরত্বের দোহাই দিয়ে সরকার এই মধ্যে ১০ টাকা কেজির চাল খোলা বাজারে বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। এখন বলছে ভুখা নাগরিকের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যাবে সরকারি ত্রাণ-সাহায্য। এটা যদি কার্যকর করা সম্ভব হয় তবে সেটাই হবে বাংলাদেশের জন্য ভালো একটি খবর।  

 

মোস্তফা সবুজ: দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh’s climate debt keeps climbing

As global leaders gather in Baku, Azerbaijan to discuss finance at the 29th climate conference, the most vulnerable countries like Bangladesh are demanding new and additional climate finance that does not exacerbate climate debt.

9h ago