নিউইয়র্কে করোনায় মারা যাওয়া এক বাংলাদেশি অভিবাসীর গল্প

করোনায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না যুক্তরাষ্ট্রে। সবসময় জেগে থাকা শহর নিউইয়র্কে এখন শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। এই শহরে করোনায় মারা গেছেন হাজারো অভিবাসী শ্রমিক, তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে গড়ে তোলা সাজানো পরিবারে অন্ধকার নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস।

করোনায় মৃত্যুর মিছিল থামছে না যুক্তরাষ্ট্রে। সবসময় জেগে থাকা শহর নিউইয়র্কে এখন শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ। এই শহরে করোনায় মারা গেছেন হাজারো অভিবাসী শ্রমিক, তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে গড়ে তোলা সাজানো পরিবারে অন্ধকার নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস।

এমনই একজন বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক মোহাম্মদ জাফর। তার জীবনসংগ্রামের কাহিনী তুলে ধরেছে সিএনএন।

নিউইয়র্কে জাফরের গল্পটা শুরু হয় ১৯৯১ সালে। স্বপ্ন পূরণে সে বছর নিউইয়র্কে পাড়ি জমান তিনি। অন্য অনেক অভিবাসীদের মতো কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের একটি মেসে গাদাগাদি করে থাকতেন তিনি। প্রতি মাসে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে দেশে বাবা-মায়ের কাছে পাঠাতেন। আর্থিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলে দেশে ফিরে বিয়ে করেন মাহমুদা খাতুনকে। দেশে থাকতেই স্ত্রীর গর্ভে আসে প্রথম সন্তান মাহবুব রবিন।

২০০০ সালে নিউইয়র্কের এলমহার্স্ট হাসপাতালে জন্ম হয় দ্বিতীয় সন্তান মাহতাব শিহাবের। আরেক কন্যা সন্তান সাবিহারও জন্ম হয় যুক্তরাষ্ট্রেই।

কখনো ট্যাক্সি চালিয়ে আবার কখনো ডেলিভারি ম্যান হিসেবে কাজ করে পরিবার চালিয়েছেন মোহাম্মদ জাফর। টাকা পাঠিয়েছেন বাংলাদেশে থাকা বাবা-মায়ের কাছেও। কম আয় করলেও সন্তানদের পাঠিয়েছেন শ্রেষ্ঠ স্কুলগুলোতে।

নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ বৃত্তির সুযোগের আওতায় দুই সন্তান মাহতাব ও সাবিহাকে ট্রিনিটির মতো ব্যয়বহুল স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন তিনি।

গোছানো সংসারে ঝড় বয়ে যায় ২০১৬ সালে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান স্ত্রী মাহমুদা খাতুন। এর পরের বছরই হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান ছেলে মাহতাব। সাবিহাও ভালো ফল করে কিন্ডারগার্টেনের পড়াশোনা শেষ করতে থাকে। একা হাতেই মোহাম্মদ জাফর আগলে রাখেন তার পরিবার।

হার্ভার্ডে অর্থনীতি ও ইতিহাসের ছাত্র মাহতাব বলেন, ‘আমার বাবা সারাজীবন খেটেছেন। নিজেকে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত করে সারাজীবন শুধুই পরিবারের কথা ভেবেছেন। অত্যন্ত লাভজনক বা অঢেল উপার্জনের সুযোগ আছে এমন কোনো কাজ তিনি করেননি। ট্যাক্সি চালানোর আগে তিনি ম্যাকডোনাল্ডস রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন। একসময় ডেলিভারিম্যান হিসেবেও কাজ করেছেন।’

সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বাবা সবসময় কেবল একটা জিনিসই নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন যে, নিউইয়র্কে এবং বাংলাদেশে তার পরিবার যেন অভাব অনটনে না থাকে।’

করোনা মহামারিতে মার্চ মাসে হার্ভার্ড বন্ধ ঘোষণা করা হলে বাড়ি ফিরে যান মাহতাব। এর আগে থেকেই সেলফ কোয়ারেন্টিনে ছিলেন বাবা মোহাম্মদ জাফর। তবে, মাঝেমাঝে ট্যাক্সি চালানোর চাকরিটা ঠিকঠাক আছে কিনা খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বের হতেন তিনি। গায়ে সামান্য জ্বর নিয়েও তিনি কয়েকদিন বাইরে গেছেন। কিন্তু একদিন হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে স্থানীয় মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।

গত ১ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ছাড়েন জাফর। সারাজীবন হাড়ভাঙা খাটুনিতে গড়ে তোলা সাজানো সংসারে অন্ধকার মেঘ নিয়ে আসে করোনাভাইরাস।

মাহতাব বলেন, ‘হার্ভার্ড পর্যন্ত যেতে কতোটা আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা আমি জানি। আমার ছোট বোন মাত্র সেকেন্ড গ্রেডে পড়ছে। এই বয়সে বাবা-মাকে হারানোর শূন্যতা সে কীভাবে বয়ে বেড়াবে!’

এতিম সন্তানদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মাহতাবের বন্ধুরা। দুঃসংবাদ শোনার পর থেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে পরিবারটির দেখভাল করতে শুরু করেছে তারা। একটি তহবিল গঠন করে মাহতাবের স্কুল জীবনের সহপাঠী উইল ক্র্যামার। ‘গো-ফান্ড-মি’ নামে ক্যাম্পেইন শুরু করেন তিনি। সব সম্প্রদায়ের মানুষ কম-বেশি তাতে অনুদান দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় থেকে প্রায় প্রায় আড়াই লাখ ডলারের অনুদান সংগ্রহ করেছেন মাহতাবের বন্ধুরা। 

উইল ক্র্যামার বলেন, ‘তারা এতিম হতে পারে কিন্তু একা না। আমরা সবাই ওদের পাশে আছি।’

নিউইয়র্কের অভিবাসী প্রায় সবার জীবনের গল্প অনেকটা এমনই। তারা সবাই কঠোর পরিশ্রমে উন্নত জীবনের আশায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। তাদের সন্তানদের উন্নত জীবন, ভালো শিক্ষার জন্য সারা জীবন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন।

মাহতাব বলেন, ‘বাবা সবসময় আমরা কতোটা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি সেটা বোঝাতেন। বলতেন, আমরা সৌভাগ্যবান। যে সুযোগ সুবিধা আছে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। তাই সবসময়ই আমরা পড়াশোনার ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাবা নিজে এতটা পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু তার একটুও সুফল তিনি ভোগ করেননি। আমরা আজ স্বাধীনভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে যাচ্ছি। এই পথ নির্মাণ করে দিয়েছেন আমাদের বাবা। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

8h ago