‘আগে তো খাবার পরে করোনা’

ভাষানটেক ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের সামনে খাদ্য সহায়তা জন্য দাঁড়িয়ে বস্তিবাসী নাছিমা বেগমকে শুনতে হয়েছে, ‘এহন ত্রাণের লাইগ্যা লাইনে ক্যান, ভোট দেবার সময় তো আরেকজনকে দিছিস’।
ভাষানটেক দামালকোট বস্তির কর্মহীন দরিদ্ররা রাস্তায় দাঁড়িয়েছে খাদ্য সহায়তা আশায়। ছবি: স্টার

ভাষানটেক ১৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসের সামনে খাদ্য সহায়তা জন্য দাঁড়িয়ে বস্তিবাসী নাছিমা বেগমকে শুনতে হয়েছে, ‘এহন ত্রাণের লাইগ্যা লাইনে ক্যান, ভোট দেবার সময় তো আরেকজনকে দিছিস’।

শুধু তাই নয় লাইনে দাঁড়ানোর কারণে ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাকে লাঠিপেটা করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন নাছিমা।

দ্য ডেইলি স্টারের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিন সন্তানের জননী নাসিমা বেগম বলেন, ‘ত্রাণ দিতে না চাইলে না দিবে, মারধর করার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’

গত কয়েক দিন রাজধানী ও এর উপকণ্ঠে কয়েকটি বস্তি এলাকা ঘুরে এমন আরও অনেক ঘটনার কথা জানা গেল।

গত ২৬ মার্চ সারাদেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় ও স্বল্প আয়ের লোক চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি, রাজধানীর ভাষানটেক, কড়াইল ও মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকার বস্তিতে গেলে অনেকেই জানান, তাদের ঘরে খাবার নেই। অনেকে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে কিছু কিছু খাবার কিনছেন। কোথাও কোনো ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না, কোন দোকানদার বাকিতে কোন সদাই দিচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা যায়, অনেকের ঘরে সন্তানরা কান্নাকাটি করছে, অনেকে আবার রাস্তায় ছোটাছুটি করছে। অনেকের সঙ্গে কথা হয়। জানান, তারা কর্মহীন। ঘরে খাবার নেই তাই খাবারের আশায় এখানেই ঘোরাফেরা করছেন, দৌড়াদৌড়ি করছেন যদি কোন ত্রাণ পাওয়া যায়।

বেশিরভাগ বস্তিবাসী হলেও নিম্নবিত্তের লোকেও খাদ্য সহায়তার আশায় ঘুরতে দেখা গেছে। অনেকের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। তারা জানান, হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়া এবং লকডাউন এর ফলে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছেন। জীবন ধারণ করা এখন তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও তারা শুনেছে যে দরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু, প্রায় ১ মাস হয়ে আসছে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত খাদ্য সহায়তা আসেনি।

অনেকে অভিযোগ করে বলেছেন, কিছু ত্রাণ যাও এসেছে তবে সুষ্ঠু বন্টন হয়নি। নিজস্ব লোকদের মধ্যে কিছু দিয়েছে এবং কিছু তারা নিজেরাই আত্মসাৎ করছে।

জানান, খাবারের নিশ্চয়তা না থাকলে এই নিম্নআয়ের মানুষেরা ঘরে থাকতে পারবে না। খাবারের জন্যই তাদেরকে রাস্তায় আসতে হবে।

কামরাঙ্গীরচরে রিকশাচালক মনির হোসেন ঢাকায় প্রায় ২০ বছর ধরে রিকশা চালান। মনির বললেন, ‘পাঁচ সদস্যের সংসার আগে কখনোই এতো আর্থিক অনটনের মুখে পড়ি নাই। মাঝে মাঝে অসুস্থ থাকলে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তায় সংসার চালিয়েছি। কিন্তু, এখন সবারই অবস্থা খারাপ। কেউ সহায়তা করতে পারছে না। কোন ত্রাণ পাচ্ছি না।’

‘রিকশা নিয়ে বের হতে গেলে পুলিশ রিকশার সিট নিয়ে যায়’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ রিকশা চালাতে দেয় না। পরিবারের কারো মুখের দিকে তাকাতে পারি না। ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে।’ আর্থিক সহায়তার জন্য বিভিন্ন বিত্তশালীদের কাছেও গিয়েছেন বলে জানান মনির। ‘কিন্তু, তেমন কিছু পাই নাই,’ যোগ করেন তিনি।

পূর্ব শেওড়াপাড়া পাকারমাথা এলাকায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য গলির ভিতরে চলাচলরত কয়েকটি রিকশার সিট রেখে দিচ্ছিলেন। জানতে চাইলাম, ‘কেন রিকশার সিট রাখছেন?’ কাফরুল থানার এক পুলিশ সদস্য বললেন, ‘লোকজনকে করোনাভাইরাস থেকে দূরে রাখার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ এসেছ উপর পুলিশের মহল থেকে।’

ওইখানেই কথা হয় এক রিকশাচালকের সঙ্গে। তিনি পুলিশকে অনেক অনুনয় বিনয় করছিলেন তার রিকশার সিট ফিরে পাওয়ার জন্যে। ওই রিকশাচালকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘আপনি এই পরিস্থিতিতে রিকশা নিয়ে কেন বের হয়েছেন?’ উত্তরে বললেন, ‘একদিন রিকশা নিয়ে বের না হলে পরিবারের কারো মুখে খাবার জোগাড় হয় না। গত এক সপ্তাহ ধরে রিকশা চালাতে পারতেছি না। রাস্তায় পুলিশ বাধা দেয়, মারধর করে।’

‘আজ রিকশা নিয়ে বের হয়েছি যদি কয়টা টাকা পাই তাইলে ২-৩ দিন পর আবার রিকশা নিয়ে বের হবো। এখন যদি এই রিকশার সিট নিতে না পারি তাহলে মালিক আর রিকশা দিবে না। রিকশা চালাতে না পারলে সংসার চলবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোথাও থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা পাই নাই। সবাই শুধু বলে ঘরে থাকো, ঘরে থাকো। ঘরে থাকলে সংসার কীভাবে চলবে? এভাবে রিকশা বন্ধ করে দিলে করোনাভাইরাসে মরার আগেই না খেয়ে মরে যাবো।’

পূর্ব কাজীপাড়া মিরপুর মসজিদের সামনে এক নারী দুই সন্তান নিয়ে রাস্তায় বসে ছিলেন। তারা রাস্তায় চলাচলকারী লোকজনের কাছে আর্থিক সহায়তা চাচ্ছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে। বললাম ‘আপনাকে দেখে তো ভদ্র ঘরের মনে হচ্ছে। আপনি কেন মানুষের কাছে আর্থিক সহায়তা চান?’

তিনি উত্তরে বলেন, ‘গত দুই বছর আগে স্বামী মারা গেছে। একটা ছোট গার্মেন্টসে চাকরি করতাম। গার্মেন্টসের বেতন আর আত্মীয়স্বজনের আর্থিক সহায়তায় চলতেছিলাম। বর্তমানে ঘরে কোনো খাবার নাই। ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে লোকলজ্জার ভয় দূরে সরে গেছে। রাস্তায় নেমেছি যদি কিছু আর্থিক সহায়তা পাই তাহলে কিছুদিন চলতে পারব।’

ঢাকার উপকণ্ঠে জিনজিরা অমিতাভপুর এলাকার একটি টিনশেড বাড়িতে ২৭ পরিবারের বসবাস। শেখ উজ্জল নামে একজন বললেন, ‘এখানের পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্য ১১০ জন। সবার গ্রামের বাড়ি বিভিন্ন জেলায়। সবাই কাজের সন্ধানে এখানে এসে বসবাস করছে।’

জানালেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে সবাই বেকার হয়ে আছেন। ঘরে খাবার নেই। কোনো ত্রাণ নেই। তারা স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়ায় ত্রাণ পাচ্ছেন না। উজ্জল বললেন, ‘খাবারের সন্ধানে বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করি। করোনার ভয়ে তারা ঘরে থাকতে পারছি না। আগে তো খাবার পরে করোনা।’

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago