করোনা সংকট: ভাঙ্গনের মুখে পাশ্চাত্য পরিবার
ইতালিসহ ইউরোপের দেশে দেশে করোনা লকডাউন প্রায় দুই মাস হতে চললো। এই সময়ের মধ্যে সরকার-প্রশাসনকে নানা রকমের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। মানুষকে ঘরবন্দি করে রাখা যে কতো কঠিন কাজ, তা প্রশাসন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। একই ভাবে ঘরে থাকা যে কতো কষ্টের, তাও বুঝতে পেরেছে জনগণ।
ইতালির সামাজিক এবং পারিবারিক অধিদপ্তর জানিয়েছে, লকডাউনে ঘরবন্দি হয়ে থাকার কারণে আশংকাজনক হারে পারিবারিক কলহ ও সহিংসতা বেড়ে গেছে। কিছু কিছু কলহ এতটাই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিবারগুলোই ভাঙ্গতে বসেছে। খুন-জখমের মতো ঘটনাও ঘটছে।
লাগাতার লকডাউনের ফলে ইউরোপের দেশগুলোয় অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বড় বড় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ। শেয়ার বাজারে দরপতন হচ্ছে প্রতিদিন।
ইতালির অর্থনৈতিক হৃদপিণ্ড বলে পরিচিত ‘ফিয়াত’ জানিয়েছে, এভাবে আরও কিছু দিন চলতে থাকলে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭০ ভাগ কাজ স্থায়ী ভাবে বন্ধ করে দিতে হবে।
দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে এত দীর্ঘ সময় মানুষ ঘরবন্দি হয়ে থাকার কারণে নানা প্রকারের স্বাস্থ্যগত জটিলতা তৈরি হচ্ছে। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে জনগণের কর্মক্ষমতা কমছে। শরীরে ক্ষতিকর হরমোনের চাপ বেড়ে যাচ্ছে, বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে মানুষ। বিশেষ করে নারী ও শিশু-কিশোররা মানসিক ভাবে দুর্বল এবং শারীরিক ভাবে স্থুল হয়ে যাচ্ছে। যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ইতালির লকডাউন সময়কালে পারিবারিক কলহ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। যা সরকার এবং প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে।
ইতালির সরকার এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে লকডাউন কিছুটা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে শিশুদের পোশাক ও বই-খাতার দোকান সপ্তাহে দুই দিন খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু কারখানায় কাজ শুরু হয়েছে। আগামী মাস থেকে পর্যায়ক্রমে বার, রেস্টুরেন্ট এবং কম সংক্রমিত এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানুষ দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থেকে এবং প্রতিমুহূর্তে নেগেটিভ খবর দেখে ও শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এতে শরীরের ক্ষতিকর কোষগুলো এবং বিশেষ ধরণের স্ববিরোধী হরমোনের প্রভাব বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ অল্পতেই রেগে যাচ্ছে, পরস্পরকে সহ্য করার ক্ষমতা কমে আসছে। এর থেকে বাঁচতে হলে অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষকে ঘরের বাইরে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বাজারে না আসা পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী হবে।
তারা বলেন, এখনো ইতালির নতুন করোনা সংক্রমণ প্রতিদিন হাজারের নিচে নামানো সম্ভব হয়নি। সুতরাং এই মুহূর্তে লকডাউন শিথিল করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
তাদের মতে এখন আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার। কারণ, ইউরোপের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মের আনাগোনা শুরু হয়েছে। চারদিকে মশার উপদ্রব বাড়ছে। মশার কারণে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে এই মরণ ভাইরাস সহজে ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাছাড়া গ্রীষ্মের আবহাওয়ায় করোনাভাইরাস নতুন কোনো রূপ ধারণ করে কিনা সেটাও দেখা দরকার।
ঘরবন্দি থাকার কারণে পারিবারিক সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার দৃশ্য শুধু ইতালিতে নয়, গোটা ইউরোপে দেখা যাচ্ছে। ইউরোপীয় গণমাধ্যমগুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে এসব খবর সামনে আনতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক এবং টিভি থ্রি বাংলার প্রধান সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘টানা লকডাউন পশ্চিমা দেশগুলোর সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এক ধরণের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সমাজে ও পরিবারে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন। এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া যে কতোটা লোমহর্ষক, তা শুধু একটি উদাহরণেই বোঝা যাবে। যুক্তরাজ্যের গত ১০ বছরের রেকর্ড অনুযায়ী প্রতি ৩ দিনে একজন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা যান। অথচ লকডাউন শুরু হওয়ার পরে (২৩ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিল) মাত্র তিন সপ্তাহে ১৬ জন নারী পারিবারিক সহিংসতায় মারা গেছেন। যা স্বাভাবিক সময় থেকে দ্বিগুণেরও বেশি।’
শামসুল আলম লিটন আরও বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে পারিবারিক সহিংসতা হলে নারী, পুরুষ এবং শিশুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু করোনা সংকটের কারণে এসব কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনা সংকটকালে পারিবারিক সহিংসতা হলেও বাড়িতেই থাকতে হবে।’
পাশ্চাত্য সভ্যতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘পাশ্চাত্য সভ্যতা উপর থেকে চকচক করলেও এই বিষয়গুলো অনেকটা প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো। পাশ্চাত্যের সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বহু আগে থেকেই নড়বড়ে ভিত্তির উপর টিকে আছে। যার ফলে, জনগণের মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিনিয়ত মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিসংখ্যান বলে, কেবল যুক্তরাজ্যেই পারিবারিক সংকটের কারণে ৭৪ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগেন।’
আশংকা প্রকাশ করে শামসুল আলম লিটন বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের লকডাউনের প্রথম ৩ সপ্তাহের পারিবারিক সহিংসতা বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায়, মাসের পর মাস এই লকডাউন চলতে থাকলে করোনাক্রান্ত না হয়েও পারিবারিক সহিংসতায় বহু মানুষের মৃত্যু হবে।’
তিনি পশ্চিমা সরকারগুলোকে দায়ী করে বলেন, ‘এসব দেশের সরকার সামরিক খাতে যতো অর্থ ব্যয় করে, মানুষের স্বাস্থ্য খাতে তত করে না। গবেষণামূলক কাজ এসব সরকারের কাছে সব সময় অবহেলিত। যার ফলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় তারা হাবুডুবু খাচ্ছে। একই ভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য সরকারগুলোকে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, অর্থ ব্যয় করতে দেখা যায় না। যে কারণে মানুষ ব্যাপক আকারে ‘বিষণ্ণতায়’ ভুগে পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা রকমের অসুস্থ কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। পশ্চিমা সরকারগুলোর উদাসীনতা দেখে মনে হয়, তারা করোনাভাইরাসের মতো মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও একটা মহামারির জন্য অপেক্ষা করছে।’
আমরা জানি ইউরোপে যান্ত্রিক সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সভ্যতা হ্রাস পেয়েছে। এখন ইউরোপের দেশগুলোতে পরিবার বলতে যা অবশিষ্ট আছে তা খুবই ঠুনকো। কথায় কথায় পরিবার ভেঙ্গে যায় সেখানে। সকালে বিয়ে হয় তো বিকেলে উকিল বাড়ি যায় তালাকের নোটিশ করতে। সবাই এখন একা থাকতে শিখে গেছে। পারিবারিক কোনো বন্ধন নেই, মায়া নেই। প্রেম-ভালোবাসা হয়ে গেছে উৎসব-পার্বণের মতো। কিছু উন্মাদনা আর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সব কিছু সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা বা নববিবাহিত যুগলরা তাদের ভালোবাসা ধরে রাখতে নানা প্রকারের সংস্কারে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। ইউরোপের দর্শনীয় স্থানগুলোতে দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকারা লাখ লাখ তালা ঝুলিয়ে চাবি পানিতে ফেলে দেয়। তাদের বিশ্বাস এতে তাদের ভালোবাসা তালাবন্দি হয়ে থাকবে।
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেন, ইউরোপের দেশে দেশে অপরাধ প্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া। মানুষ পরিবারহীন হয়ে পড়ায় নানা প্রকারের মানসিক সমস্যায় ভোগে, বিষণ্ণ হয়। মানুষের ভেতর থেকে মায়া উঠে যায়, ভক্তি-শ্রদ্ধা কমে যায়। মানুষের গড় আয়ু কমে যায়, ফলে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। মাদকসহ নানা প্রকারের অশ্লীলতায় অভ্যস্ত হয়ে হিংস্র হয়ে যায় তারা। যা ইউরোপীয় সভ্যতায় গলার কাটা হয়ে বিঁধে আছে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও এখান থেকে বের হয়ে আসা সহজ হচ্ছে না।
Comments