তরমুজ এখন চাষির ‘গলার কাঁটা’
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলি ইউনিয়নের উত্তর কচ্ছপিয়া গ্রামের কৃষক ছিদ্দিক উল্ল্যাহ (৫০) চলতি বছর ৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। তবে, ভালো ফলন তার মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি।
কৃষক ছিদ্দিক উল্ল্যাহ বলেন, ‘তরমুজের বাম্পার ফলন হলেও এ বছর করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে তরমুজের বাজারে। তরমুজ পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে।’
তিনি জানান, এতে করে তার নিট লোকসান হয়েছে লাখেরও বেশি টাকা। তিনি চলতি বছর পাঁচ একর জমিতে তরমুজ চাষ করতে গিয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছেন। তরমুজ চাষ করার আগে তিনি সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদের একটি বাড়ি একটি খামার থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে দেড় লাখ টাকা ঋণ করেন। সেই সঙ্গে নিজের ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই তরমুজ চাষ করেন। মার্চের শেষের দিকে তার তরমুজ পাকা শুরু হয়। কিন্তু, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে নোয়াখালী জেলা লকডাউন থাকায় ক্রেতা সংকটে পড়েন তিনিসহ উপজেলার তরমুজ চাষিরা।
প্রতি বছর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ ও এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তরমুজ ব্যবসায়ীরা সুবর্ণচর এসে তরমুজ খেত দেখে চাষিদের কাছ থেকে খেতের তরমুজ কিনে নিয়ে যান। কিন্তু, এ বছর করোনার কারণে সবাই ক্রেতা সংকটে পড়েছেন।
ফলে, ছিদ্দিক উল্ল্যাহ পাঁচ একর জমির তরমুজ ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এতে তার লোকসান হয়েছে লাখেরও বেশি টাকা। অথচ গত বছর তিনি দুই একর জমিতে তরমুজ চাষ করে এক লাখ ২০ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। এখন তিনি মহাজনের সুদের টাকা ও একটি বাড়ি একটি খামারের ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করবেন এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে কী খেয়ে বাঁচবেন তা— নিয়ে চিন্তায় দিশেহারা।
ছিদ্দিক উল্ল্যাহর মতো আরও অনেক কৃষক আছেন যারা তরমুজ চাষ করে বিপাকে পড়েছেন। লাভ তো দূরের কথা, পুঁজি নিয়েও ঘরে ফিরতে পারছেন না তারা। উপজেলায় ছিদ্দিক উল্ল্যাহ ছাড়াও কথা হয় নুরুল হক, আলমগীর হোসেন, হারুন, আব্দুল কুদ্দুস, ইউনুছ মিয়সহ ১০ জন চাষির সঙ্গে। এমনই হতাশা ও কষ্টের কথা তাদের সবার মুখে। ফলন ভালো হলেও তাদের কপালে চেপে বসেছে চিন্তার ছাপ।
সুবর্ণচর উপজেলার চরজুবলি ইউনিয়নের উত্তর কচ্ছপিয়া গ্রামের কৃষক হারুন চলতি বছর চার একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু, করোনার কারণে তিনি তার খেতের তরমুজ এক লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তার ৮০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। গত বছর তরমুজ চাষ করে তিনি দেড় লাখ টাকা লাভ করেছিলেন।
কৃষকরা জানান, প্রতিবছর বিভিন্ন জেলার তরমুজ ব্যবসায়ীরা সুবর্ণচরে এসে তরমুজ কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু করোনার কারণে এবার কোনো পাইকার আসছেন না। তাদেরই তরমুজ তুলে ট্রাকের করে চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিল্লায় বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে পরিবহন খরচ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে গিয়ে তাদের প্রচুর লোকসান হচ্ছে।
সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘নোয়াখালীর কৃষি রাজধানী খ্যাত সুবর্ণচরে চলতি বছর তিন হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। গত বছর যা ছিল ১০ হাজার হেক্টর। তিন মাসের মধ্যে এ ফসল তোলা যায়। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তরমুজ চাষ শুরু হয়, পরিপক্বতা আসে মার্চ মাসে এবং মার্চের শেষের দিকে ও এপ্রিলে বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু, চলতি বছরের শুরুতে, অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে ভারী বর্ষণ হয়েছিল। যার কারণে এ বছর দেরিতে চাষ শুরু হয়েছে। ফলনও দেরিতে হয়েছে। তবে ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু, করোনাভাইরাসের প্রভাবে তরমুজের দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম।’
Comments