ক্ষুধায় জ্বলছে কালিটি
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কালিটি চা বাগানে ৩৪-বছর বয়সী স্থায়ী চা-শ্রমিক জগন্নাথ আলমিকের তিন সদস্যের সুখি পরিবার ছিল। ছোট বাড়িতে ছোট পরিবারে ভালোই যাচ্ছিল দিনকাল।
কিন্তু, কপালে এতো দুঃখ আসবে ভাবতেও পারেননি জগন্নাথের স্ত্রী। তার স্ত্রী মুন্নি বলছিলেন, ‘তিন মাস আগে মজুরি না পাওয়ায় তার স্বামী বড় অভাবে পড়ে যায়। কারণ এই পরিবার পুরোপুরি মজুরির উপর নির্ভরশীল। পরিবার খরচ বহন করতে তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন। সে সময় থেকে পরিবার চালাতে ঋণে পড়েছিলেন। হঠাৎ করেই তিনি দুই মাস আগে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পড়েন।’
‘তবে আমাকে আরও দুখী করে তুলেছে আর্থিক সঙ্কট। এখন তার চিকিৎসা ঠিকমত করাতে পারছি না। আমরা এখন মজুরি ছাড়া অসহায় হয়ে পড়েছি। ঘরে খাবার নেই। বেশিরভাগ সময় উপোষ করতে হয়।’
মুন্নি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার স্বামী কয়েকদিন থেকে কিছু বলতে পারেন না। আবার ঝড়ের কারণে রোববার ভোরে আমাদের ছোট্ট ঘরটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে আমার আঘাত হয়েছে দ্বিগুণ। এখন বৃষ্টি হলেই ঘর ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টি হলে না ঘুমিয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে। জানি না কতদিন এসব চলবে।’
জগন্নাথ পরিবারের মতো, চা-বাগানের হাজার হাজার শ্রমিকরে জন্য এটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। তারা গত ১৩ সপ্তাহ ধরে মজুরি না পাওয়ার কারণে খাদ্য সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছেন। এ কারণে তারা গত দুই মাস থেকে ভুখা মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ ও বকেয়া বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রাখছেন।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালিটি বাগানটি ‘জোবেদা টি কোম্পানি লিমিটেডের’ নামে সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া হয়েছে। বাগানে মোট ১,০০০ শ্রমিক আছে। তাদের মধ্যে ৫৩৭ জন স্থায়ী শ্রমিক। প্রত্যেক শ্রমিক দৈনিক ১০২ টাকা করে মজুরি পান।
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মজুরি পরিশোধের কথা। কিন্তু, ১৩ সপ্তাহ ধরে শ্রমিকেরা মজুরি পাচ্ছেন না। বাগানের শ্রমিক সরদার ও স্টাফদেরও ১১ মাসের বেতন আটকা পড়ে আছে।
বাগান শ্রমিক পঞ্চায়েত কমিটির সম্পাদক উত্তম কালোয়ার বলেন, ‘শ্রমিকেরা এমনিতেই সামান্য মজুরি পান। এরপর ১৩ সপ্তাহ থেকে কেউ সেই মজুরি পাচ্ছেন না। কাজ করেও মজুরি মিলছে না। ঘরে চাল-ডাল নেই। উপোস করে দিন কাটাতে হচ্ছে। বাগান কর্তৃপক্ষ আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করছে।’
চা-শ্রমিক সন্তান মোহন রবিদাশ বলেন, ‘আমাদের ১১ দফা দাবিগুলোর ভেতরেআছে চা শ্রমিকদের মজুরি ও শ্রমিক সর্দার ও স্টাফদের বকেয়া বেতন পরিশোধ। টাকা না পেয়ে তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এই বাগানে চিকিৎসার একমাত্র আশ্রয়স্থল যে হাসপাতালটি সেখানেও তিন মাস ধরে চিকিৎসাসেবা বন্ধ।’
‘এই বাগানের চা-শ্রমিকদের ২৬ মাসের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করেছে বাগান মালিক,’ অভিযোগ রবিদাশের।
তার আরও অভিযোগ, ‘এই বাগানে করোনা মোকাবিলায় কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরের কথা সামান্য একটা মাস্কও কেউ দেয়নি। তাই ৯৯ ভাগ মানুষ মাস্কহীনভাবে চা-বাগানে কাজ করছে।’
‘সম্প্রতি, ঢাকা থেকে কম্পানির যে কয়েকজন স্টাফ এই বাগানে প্রবেশ করেছে তাদের ব্যাপারে প্রশাসন কোনও কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি,’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ পেটের দায়ে আজ আন্দোলন করছে। ভূখা মিছিল করছে। এখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত হচ্ছে না। কিন্তু তারপরেও তাদের প্রতি কেউই দৃষ্টি দিচ্ছে না।’
চা শ্রমিক দয়াল অলমিক বলেন, ‘বাগানে চিকিৎসক নেই। শ্রমিকেরা বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করালে বাগান কর্তৃপক্ষ বিলের টাকা দেয় না। বাগানে বিরাজমান এসব সমস্যার কথা তুলে ধরে এর প্রতিকার চেয়ে গত ৫ জানুয়ারি শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকের কাছে লিখিত আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু, কোন কাজ হয়নি। এই দুর্যোগের সময় আমরাতো কারো দয়া চাইছি না। আমরা আমাদের হক দাবি করছি।’
চা-শ্রমিক নেতা বিশ্বজিত দাস বলেন, ‘একদিকে ১৩ সপ্তাহ ধরে মজুরি বঞ্চিত অন্যদিকে করোনার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন এই বাগানের শ্রমিকরা। অবিলম্বে এই বাগানের সংকট নিরসন করা না গেলে শত শত চা শ্রমিকের জীবন বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
অতিদ্রুত যদি সমাধান না হয় তাহলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলেও হুশিয়ারি দেন তিনি।
চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সম্ভু চৌধুরী দাশ বলেন, ‘বাগানে দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যা। শ্রমিকদের আগের মজুরিরও বেশ কিছু টাকা বকেয়া পড়ে আছে। অনেক শ্রমিক জরাজীর্ণ কাঁচাঘরে বাস করছেন। এসব ঘর মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অবসরে যাওয়া শ্রমিকেরা তহবিলের টাকা পাচ্ছেন না। অথচ প্রত্যেক শ্রমিকের মজুরি থেকে সাত শতাংশ করে ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা কেটে রাখা হয়। এর সঙ্গে মালিক পক্ষ আরও সাত শতাংশ যোগ করে মোট ১৫ শতাংশ টাকা শ্রম অধিদপ্তরে জমা দেওয়া কথা। বাগান কর্তৃপক্ষ তা-ও করছে না।’
মজুরি বন্ধের বিষয়ে কালিটি বাগানের ব্যবস্থাপক প্রণব কান্তি দাশ বলেন, ‘কোম্পানির কাছ থেকে যথাসময়ে টাকা না পাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।’
তিনিসহ বাগানের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির ১১ মাসের বেতন বন্ধ আছে বলেও জানান তিনি।
কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফি আহমেদ সলমান বলেন, ‘মালিকের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করবো। নয়তো মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
Comments