কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও ফ্যাভিপিরাভির নিয়ে ক্ষুদ্র জ্ঞান

নিউইয়র্কে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা খুব একটা কমছে না। যদিও হাসপাতালে ভর্ত্তির সংখ্যা কমেছে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীর চাপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু থামেনি। সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারব না তবে ভেন্টিলেটরে দেওয়ার পর অন্তত ৮০ ভাগই আর ফিরে আসেনি। তার মানে কি মুমূর্ষু অবস্থায় যে ওষুধপত্র দেওয়া হয় সেগুলো কোনো কাজে আসছে না! বিশেষ করে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন?
ছবি: সংগৃহীত

নিউইয়র্কে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা খুব একটা কমছে না। যদিও হাসপাতালে ভর্ত্তির সংখ্যা কমেছে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রোগীর চাপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু থামেনি। সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে বলতে পারব না তবে ভেন্টিলেটরে দেওয়ার পর অন্তত ৮০ ভাগই আর ফিরে আসেনি। তার মানে কি মুমূর্ষু অবস্থায় যে ওষুধপত্র দেওয়া হয় সেগুলো কোনো কাজে আসছে না! বিশেষ করে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন?

নিউইয়র্কে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন এমন রোগীদের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া হচ্ছে এমন তথ্য অনেকেরই জানা আছে। বলা হচ্ছে, গবেষণার অংশ হিসেবে যাচাই-বাছাই করে রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। কারণ হার্টের ওপর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। এটি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করতে পারে। তাই যাদের হার্টের সমস্যা আছে, উচ্চরক্তচাপ আছে তাদের জন্য এটির ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া চোখের রেটিনার স্থায়ী ক্ষতিসাধন হতে পারে। রেটিনার ক্ষতি মানে তো অন্ধত্ব।

অনেকে বলছেন, বেঁচে থাকার জন্য এটুকু ক্ষতির ঝুঁকি তো নিলে দোষ কী! জীবন বলে কথা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখেও একই কথা। এটি ব্যবহারে হারানোর কী আছে? ট্রাম্পের এই কথা মাটিতে পড়তে দেয়নি মিডিয়া। তার আগেই জবাব তৈরি করে ফেলেছে। আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনে জীবন হারানোর ঝুঁকি আছে।’

এর আগে ডা. এন্থনি ফাউচি বারবার বলে এসেছেন, ‘হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকর, নিরাপদ ওষুধ হিসেবে অনুমোদিত নয়। এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন এবং সেই গবেষণা চলছে।’

কোনো গবেষণাই নিশ্চিত করে বলছে না যে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য অনুমোদিত। যেহেতু হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন একটি পরিচিত ওষুধ, ম্যালেরিয়াসহ বেশ কিছু অটোইমিউন ডিজিজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তাই এটির ব্যবহারবিধি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ইতোমধ্যে জানা আছে।

যেহেতু এর আগে নতুন করোনাভাইরাসের পূর্ববর্তী দুটি প্রজন্মের করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুটি সংক্রামক ব্যাধি ‘সার্স’ ও ‘মার্স’-এ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারে কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়ায় অনেকেই এটিকে কোভিড-১৯ এ প্রয়োগে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

মহামারির সময় হাতের কাছে যা থাকে তার মধ্যে অভিজ্ঞানের আলোকে যেটি বেশি কার্যকর মনে হয় সেটিকেই চিকিৎসকরা বেছে নেন। কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। করোনাভাইরাস জাতীয় পূর্ববর্তী সংক্রমণ ‘মার্স’র প্রাদুর্ভাবে ব্যবহৃত ওষুধ হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও এরিথ্রোমাইসিনকেই নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা হিসেবে আপাতত ঠেকার কাজ চালানোর মতো করে বেছে নেওয়া হয়।

এজিথ্রোমাইসিন ইতোমধ্যে একটি বহুল প্রচলিত এন্টিবায়োটিক। তবে এন্টিবায়োটিকের বাইরেও প্রদাহ কমানোর কিছুটা ক্ষমতা এর রয়েছে।

ফ্রান্সে পরিচালিত এক গবেষণায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত ১৮১ জন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করে বিশেষ কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। অতিসম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৬৮ জন কোভিড-১৯ রোগীর ওপর হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগের গবেষণা বেরিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে যে ৯৭ জন রোগীকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেওয়া হয় তাদের ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেছে। আর যে ১৫৮জন রোগীকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন দেয়া হয়নি তাদের মধ্যে মৃত্যু হার হলো ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। তাছাড়া, এর সঙ্গে এজিথ্রোমাইসিন দিয়ে বিশেষ কোন আশাব্যঞ্জক ফল আসেনি।

এর মানে আপাতভাবে মনে হচ্ছে এটি ব্যবহারে লাভ নেই বরং ক্ষতির ঝুঁকি থাকছে। ইতোমধ্যে সিডিসি তাদের কোভিড-১৯ এর গাইডলাইন থেকে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনকে বাদ দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেনো ডাক্তার না হয়ে অযাচিতভাবে হাইড্রোক্সিক্লুরোকুইনকে ম্যাজিক ড্রাগ বলেন সেটিকে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ব্যবহার করতে বলছেন, সেটি এখন ওপেন সিক্রেট।

ফ্রান্সের বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি স্যানফি। স্যানোফি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন তৈরি করে, বাজারে যেটি প্লাকুইনিল নামে পাওয়া যায়। স্যানোফির মিউচুয়াল ফান্ড ‘ডজ এন্ড কক্স’ এ ট্রাম্পের পরিবারের ৩ সদস্যের বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আছে। ট্রাম্পের অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান নেতা কিং ফিশার স্যানোফির একজন বড় শেয়ার হোল্ডার। এ বিষয়ে আরও অনেক কিছুই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের ওয়েবপেজে গেলে সহজেই সব পত্রিকার সূত্রকে মিলিয়ে সেসব তথ্য সারাংশ আকারে পাওয়া যাবে।

একই সঙ্গে আমাদের দেশে ফ্যাভিপিরাভির নামের ওষুধকে কোভিড-১৯ এ কার্যকর বলে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর এই মহামারির সময়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তিনটি কোম্পানিকে ওষুধটি তৈরি ও বাজারজাত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যারা এই অনুমতি পেয়েছেন তারা সরকারের কাছের লোক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই ওষুধ নিয়ে গবেষণার অবস্থা আরও প্রাথমিক পর্যায়ে।

২০১২-১৩ সালে পশুর শরীরে ফ্যাভিপিরাভির পরীক্ষা করে বেশ কিছু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একই বছর আমেরিকার এফডিএ, এটিকে ফ্লুর বিরুদ্ধে কাজ করে বলে প্রমাণ পেয়েও ওষুধটিকে বাজারজাত করেনি এর মারাত্মক কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে।

তাছাড়া, গর্ভবতীসহ বিভিন্ন ধরণের সাধারণ সমস্যায় আক্রান্তদের এই গবেষণার বাইরে রাখা হয়। যতটুকু জানা যায়, ফ্যাভিপিরাভির গর্ভস্থ ভ্রুণ ও শিশুর মারাত্মক ক্ষতিসহ গর্ভস্থ শিশুর মৃত্যু ঘটাতে পারে। পঙ্গুত্ব নিয়ে শিশু জন্ম নিতে পারে। এর বাইরেও আরও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে।

ফ্যাভিপিরাভির নিয়ে গবেষণা আপাতভাবে শেষ হয় ২০১৫ সালে। ২০১৪ সালে জাপানে এটা তৈরি করার অনুমোদন দেওয়া হলেও তার ব্যবহার শুধুমাত্র হাসপাতালে মনিটরিং সাপেক্ষে চলছে।

চীনে কোভিড ১৯ শুরু হওয়ার পর সেখানে এর ব্যবহার হয়েছে। তবে রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে এটি ব্যবহারে কিছুটা আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়। তবুও একে গবেষণাকে দুর্বল বলে অভিহিত করে অন্য কোনো দেশ এটি ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি।

এই অবস্থায় কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো আসেনি। ভ্যাকসিনও প্রক্রিয়াধীন। যতদিন এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হবে ততদিন বেঁচে থাকার লড়াইটা সহজ হবে না।

 

সজল আশফাক: লেখক-চিকিৎসক, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

5h ago