করোনাকাল, তারপর-২

ছবি: সংগৃহীত

একদিকে কিছু হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এই সংকটকালের জন্য। জানা গেছে হাসপাতালগুলোর নাম। এই সব হাসপাতালের ক্ষমতা ও প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কেও এখন আমরা অবহিত!

বছরের পর বছর সরকার কিন্তু কার্পণ্য করেনি অনেক নতুন হাসপাতাল ও একাধিক ইনস্টিটিউট তৈরি করতে। অঢেল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে সরকারি কর্তৃপক্ষকে। আফসোস! এখনো এদেশের প্রায় শতকরা ৬৫ ভাগ লোকই বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে এই সংকটকালে নতুন নতুন হাসপাতাল তৈরির কথা শুনছি। মনে রাখতে হবে হাসপাতাল কিন্তু ‘সাইক্লোন শেল্টার’ নয়। আমরা এই মুহূর্তে যে ধরনের হাসপাতাল তৈরির কথা বলছি, সেটাতো আরও বিশদ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

‘সার্স’র শিক্ষাকে পুঁজি করে সিঙ্গাপুর তাদের অনেক হাসপাতালকে ঢেলে সাজিয়েছিল। এটা ২০০৩ সালের কথা। আজ এর সুফল তারা ভোগ করছে। এখনো আমাদের অনেক হাসপাতালে (যেহেতু এদেশে যক্ষা যথেষ্ট পরিচিত রোগ) ‘নেগেটিভ প্রেসার ফ্লোর’, ফিল্টার ইত্যাদি ব্যবস্থার কনসেপ্টই নেই। এ ছাড়াও আরও আছে হাসপাতালে আনুষাঙ্গিক জরুরি কিছু বিষয়। ভেন্টিলেটরের কথা শুনছি প্রতিনিয়তই। এটা সত্য যে, আমাদের দেশে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক কম।

সরকারি-বেসরকারি মিলে হয়তো কার্যক্ষম ভেন্টিলেটর ১,২০০ থেকে ১,৫০০ এর বেশি হবে না। তাও মূলত ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে সর্বোচ্চ। প্রায়শই ভেন্টিলেটর বিদেশ থেকে আমদানি করতে দেখি। অথচ এসব অত্যাধুনিক যন্ত্রের পেছনে যে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ানকে দিনরাত্রি দাঁড়িয়ে— তাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা দক্ষ করতে পারিনি। কখনো কখনো অপর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া হলেও তার আপডেট করা হয় না।

একদিকে, হাসপাতালে যন্ত্র ক্রয়ে এক আনন্দ! অন্যদিকে, এসব চালাতে গিয়ে অসীম বেদনার সৃষ্টি হয়! অবশ্যই এর ব্যতিক্রমও আছে। ‘আই সি ইউ’ তৈরি করা তো এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহের বিষয় নয়। এতে দক্ষ-অভিজ্ঞ জনবল তৈরি করা সময়ের ব্যাপার। যত দ্রুত এই প্রশিক্ষণ শুরু হবে ততই মঙ্গল।

আধুনিক ভেন্টিলেটরের কার্যক্ষমতা ব্যাপক। শেখার অনেক কিছু আছে। যেমন, একটা স্মার্টফোনের অনেক ক্ষমতা। কিন্তু, তার কিয়াদংশই আমরা বেশিরভাগ জনগণ ব্যবহার করে থাকি। তেমনি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকলে আধুনিক ভেন্টিলেটরেরও সদ্ব্যবহার করা হবে না। এছাড়াও ‘আই সি ইউ’ তে ছোট-মাঝারি অনেক যন্ত্রপাতি রয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয়তাও সীমাহীন। ‘আই সি ইউ’ গুলোতে দেখা যাচ্ছে ব্লাড গ্যাস অ্যানালাইজার, কার্ডিয়াক মনিটর চালাতেও দক্ষ জনবল পাচ্ছি না আমরা। এমনকী, সাকার মেশিনে ‘সাকশন’ দেওয়াটাও ভালো করে শিখতে হয়। ভুক্তভোগীরা জানেন, সেখানেও মাঝে-মধ্যে কী হয়! ‘সি প্যাপ’র গুরুত্ব বাড়াতে হবে। অক্সিজেনের পর্যাপ্ত সরবারহের কথাতো অনেক পুরানো।

‘আই সি ইউ’ পুরো হাসপাতাল থেকে ভিন্ন। তাদের জনবলের গুরুত্ব ও সম্মানকে মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই স্বল্প, মধ্যম ও সুদূরপ্রসারী ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে এই বিপদ কেটে যেতে পারে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যন্ত্রপাতি কেনাকাটার সঙ্গে আরও প্রয়োজন সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ। বিদেশের হাসপাতালগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে রক্ষণাবেক্ষণে। আমাদের দেশেও বর্তমান সরকারি হাসপাতালগুলো ও অত্যাধুনিক বেসরকারি হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালেই এর পার্থক্য বোঝা যায়। টেস্ট, টেস্ট, টেস্ট বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ। এই ফাঁকে বলে রাখি, এখন কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘মহামারিতে টেস্টের চেয়ে রোগের লক্ষণ দেখেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।’

সেদিন শুনলাম, ৫,০০০ শয্যার হাসপাতাল নাকি তৈরি করতে ইচ্ছুক কেউ কেউ!

এর জন্যে যে পরিমাণ জায়গা তারা দেখাচ্ছেন সেখানে একটি আধুনিক হাসপাতাল করতে চাইলে খুব বেশি হলে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল হতে পারে। ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে অল্প দিয়েই শুরু করুন। আপনারা ১০ থেকে ৫০ শয্যা দিয়েই শুরু করুন না! ভারতের ভেলোরে অবস্থিত বিখ্যাত হাসপাতালটি মাত্র ‘এক বেড’ দিয়েই শুরু হয়েছিল। এরকম আরও কাহিনী আছে।

আরেকটি কথা না বললেই নয়, দেশের চারিদিকে বেশকিছু অকার্যকর হাসপাতাল আছে। সেগুলোকে ‘মানুষ’ করুন। যেমন, আমার জানা মতে ঢাকার পাশেই গাজীপুরে ৩০-৫০ বেডের হক মেডিকেল সেন্টার যথেষ্ট আধুনিক। মালিক পক্ষ হাসপাতালটা সরকারকে ‘করোনা হাসপাতাল’ হিসেবে হস্তান্তর করতে চায়।

নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত সাজেদা ফাউন্ডেশনের মতো তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন সেখানকার সিভিল সার্জন। ইতোমধ্যেই দেশে ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত। আমরা যদি কৌশল প্রণয়নে আরও বাস্তবধর্মী না হই তবে সামনের দিনগুলো হয়তো ভালো নাও হতে পারে।

ডা. রুবায়ুল মোরশেদ: চিকিৎসক, গবেষক, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠাতা, সম্মান ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

আরও পড়ুন

করোনাকাল, তারপর-১

Comments

The Daily Star  | English

Reward for looted police firearms brings no tips

More than 1,300 firearms and over 2,50,000 rounds of ammunition remain missing, with many reportedly now in the hands of criminals

28m ago