চা-শ্রমিক করোনা আক্রান্ত, মজুরিসহ সাধারণ ছুটির দাবি

হবিগঞ্জে এক চা-শ্রমিক ও মৌলভীবাজারে এক চা-বাগানের বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলা দুটির চা-বাগানগুলোতে।
Tea garden
ছবি: সংগৃহীত

হবিগঞ্জে এক চা-শ্রমিক ও মৌলভীবাজারে এক চা-বাগানের বাসিন্দা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জেলা দুটির চা-বাগানগুলোতে।

গত রবিবার সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষার ফলাফলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে চা-বাগানের এক বাসিন্দা ঢাকাফেরত শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়।

কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালা বলেন, ‘যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তিনি ঢাকাফেরত শিক্ষার্থী ও শ্রীমঙ্গলের একটি চা বাগানের বাসিন্দা। এছাড়াও, তিনি গত ২২ এপ্রিল ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শ্রীমঙ্গল এসে হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। এখনো তা মেনে চলছেন।’

শ্রীমঙ্গলের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আক্রান্ত শিক্ষার্থী হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় আমরা গত ২৩ এপ্রিল তার নমুনা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলাম। রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।’

শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা রোগীর বাসায় গিয়েছি। তিনি বাসাতেই আছেন। প্রাথমিকভাবে তার বাসা লকডাউন করা হবে। পরে প্রয়োজন হলে পুরো বাগান লকডাউন করা হবে।’

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে সারা দেশে যখন চলছে অঘোষিত লকডাউন, বন্ধ সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তখন চা-বাগানগুলোতে উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। ঝুঁকি নিয়েই বাগানে কাজ করছেন শ্রমিকেরা।

দেশে ১৬৬টি চা বাগানে কাজ করছেন দেড় লাখেরও বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে ১৩৪টি বাগানই সিলেট বিভাগে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বাগানের কাজ বন্ধ রাখার দাবি জানানো হলেও তা হয়নি।

গত শনিবার সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ বছরের এক শিশুর মৃত্যু ও এক চা-শ্রমিক করোনায় আক্রান্তের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শিশুটি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চণ্ডীছড়া চা-শ্রমিকের সন্তান।

চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সত্যজিত রায় দাশ বলেন, ‘বাগানের এক শ্রমিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। ওই শ্রমিক হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।’ ইতোমধ্যে চণ্ডীছড়া চা-বাগানের ১২টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

চা-শ্রমিকের সন্তানের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘শিশুটি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল। চিকিৎসার জন্য পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে ২০ দিন ঢাকায় ছিলেন। গত ২০ এপ্রিল তারা তাকে ঢাকা থেকে বাগানে নিয়ে আসেন। ঢাকা থেকে আসার কারণে ওই শিশুসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে করোনা পরীক্ষার জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজের ল্যাবে পাঠানো হলে ওই শিশু ও তার এক আত্মীয়ের করোনা পজেটিভ আসে। এরপরই চা বাগানের ১২টি বাড়ি লকডাউন করা হয়।’

তার মতে, ‘করোনা পজেটিভ ধরা পড়লেও শিশুটি মূলত ক্যান্সারের কারণেই মারা গেছে।’

খেজুরী চা-বাগানের এক শ্রমিক বলেন, ‘একজন শ্রমিক আক্রান্ত হলে তা অনেক শ্রমিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য মজুরিসহ সাধারণ ছুটি ও সরকারি বরাদ্দের দাবি জানাই। আমরাও বাঁচতে চাই।’

কুলাউড়ার মুরইছড়া চা-বাগানের মুনিয়া উরাং বলেন, ‘চা-পাতা সংগ্রহকারী নারীরা দলে দলে কাজ করেন। শ্রম আইনে বলা থাকলেও আমাদের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক শ্রমিককে একই গ্লাসে পানি পান করতে হয়। অনেকে হাতের মুঠোয় ভরেও পানি পান করেন। ভাইরাস ছড়াতে এর থেকে বিপজ্জনক আর কী হতে পারে?’

চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহ্বায়ক রাজদেও কৈরী বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের ১৬৬টি চা-বাগানের প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার চা ও রাবার শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।’

অবিলম্বে মজুরি-রেশনসহ সব শ্রমিকদের ছুটি দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে ইতোমধ্যে দেশের অনেক জেলায় লকডাউন চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে চা-বাগানে শ্রমিকদের কাজ করতে হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছেন প্রায় ১০ লাখ চা-বাগান সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী।’

চা-শ্রমিকদের ঝুঁকির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. দেবপদ রায় বলেন, ‘এখন কাউকেই ঝুঁকিমুক্ত বলা যাবে না। চা-বাগানে শ্রমিকরা খুব গাদাগাদি অবস্থায় থাকেন। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা উপকরণের অভাবও রয়েছে। ফলে তারা ঝুঁকির মধ্যেই আছেন। এ অবস্থায় তাদের ঘরে থাকাই ভালো। বিষয়টি আমি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারকেও জানিয়েছি।’

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, ‘অনেক চা-বাগান শ্রমিকদের নিরাপদ দূরত্বের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। তারা শ্রমিকদের হাত ধোয়ার সাবান ও মাস্ক দেয়নি। এসব শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।’

প্রশাসন ও বাগান মালিকরা দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে সারা দেশের চা-বাগানের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।

এ নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ চা-সংসদের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ রোধে আগে থেকেই বাগানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শ্রমিকদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলা হয়েছে। তাদের মাস্ক-সাবান দেওয়া হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কাজ করতে বলা হয়েছে। শ্রমিকেরা তা মেনেও চলছেন। চায়ের ব্যবসা এমনিতেই খারাপ। ছুটি দিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এর প্রভাব শ্রমিকদের ওপরও পড়বে। সরকারও চা বাগানে ছুটি ঘোষণার কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’

Comments

The Daily Star  | English

Tax collection falls short of IMF loan condition

government falls Tk 17,946 crore short of the revenue last fiscal year as one of IMF's $4.7 billion loan conditions

8h ago