বুড়িমারীতে আটকেপড়া ভারতীয় ট্রাকচালকদের মানবেতর জীবন
একটি ট্রাকের কেবিনে বসে নামাজ শেষে দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করছেন এক ব্যক্তি। তার নাম ইজাহার আলী। বাড়ি ভারতের বিহার রাজ্যের মতিহার জেলার পশ্চিম চম্পানগর। নামাজ শেষে তার কাছে জানা গেল— লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরে আটকেপড়া ভারতীয় ট্রাকচালকদের দুর্দশার কথা।
ইজাহার আলী (৫০) বলেন, ‘স্ত্রীকে একদিনের কথা বলে মহাজনের গাড়িতে পাটবীজ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। ট্রাক খালি করে চেকপোস্টে গেলেই গাড়িগুলো আটকে দেয়। লকডাউনের কারণে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ভারতে।’
বাড়িতে তার একমাত্র ছেলে ও স্ত্রী থাকে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন রাতেই খবর এল স্ত্রীর কোমর ভেঙে গেছে। ছেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করে ছেলে ওষুধ কিনেছে। এদিকে, ঘরে খাবার নেই।’
ইজাহার আলী বলেন, ‘রমজান মাসে পরিবার পরিজন কেমন আছে, কেমন করে চলছে সংসার জানি না।’
ইজাহার আলীর মতো আরও ৬০ জন ট্রাকচালক এখন আটকে আছেন লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দরে। গত ৪ এপ্রিল বিশেষ অবস্থায় পাটবীজ নিয়ে এ দেশে এসেছিলেন। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানিয়েও কিছুই হচ্ছে না। ফলে বুড়িমারী স্থলবন্দর চত্বরে ২৫ দিন ধরে আছেন। খাওয়া-ঘুম সবকিছুই ট্রাকে করছেন।
ভারতের ট্রাকচালক আলতাফ হোসেন (৪৫) বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার অনেক চেষ্টা করছে আমাদের দেশে পাঠানোর জন্য। কিন্তু, ভারত সরকার আমাদের দিকে দেখছে না। আমাদের পরিবারের কথা ভাবছে না। মমতা দিদি আমাদের দিকে তাকালে আমরা দেশে ফিরতে পারি। এভাবে থাকলে আমরাসহ আমাদের পরিবার মরে যাবে। দ্রুত আমাদের দেশে ফিরে নিন।’
তিনি আরও বলে, ‘এখানে এক কাপড়ে এসেছি। ট্রাকে ঘুমাতে হচ্ছে। ট্রাকেই খাওয়া-দাওয়া করতে হচ্ছে। করোনার কারণে সব দোকান বন্ধ। নিজেরাই রান্না করে খাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ আন্তরিক। তারা খাবার দিচ্ছেন। এমনকী কাপড়ও দিয়েছেন,’ যোগ করেন তিনি।
ভারতীয় ট্রাকচালক রমেশ দাস (৪৮) বললেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আমাদের খাবার না দিলে না খেয়ে মরতে হতো। শুধু খাবার নয়, তারা আমাদের নিয়মিত খোঁজ রাখছেন। কাস্টমস ইয়ার্ডের ভেতরই থাকছি, কোথাও বের হতে পারছি না। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। আমরা দেশে যেতে চাই। পরিবারের সঙ্গে থাকতে চাই।’
‘বাংলাদেশে আসা ৬১ ভারতীয ট্রাকচালকের পরিবারে ৬১ ধরনের সমস্য চলছে। কিন্তু, তারা আটকে আছেন বাংলাদেশে’ এমনটি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ভারত আন্তরিক না হওয়ায় আটকে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।’
বুড়িমারীতে আটকেপড়া ভারতীয় ট্রাকচালকদের মানবিক সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়িয়েছেন স্থানীয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ফারুক হোসেনসহ বেশ কয়েকজন। তারা নিজের টাকায় আটকেপড়া ট্রাকচালকদের দিচ্ছেন খাদ্য সহায়তাসহ সব ধরনের সহায়তা।
ফারুক হোসেন বলেন, ‘তাদের পাশে দাঁড়ানো একান্ত কর্তব্য। তারা ভারত থেকে বাংলাদেশে এসে আটকে পড়েছেন। পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় রয়েছেন। আমার সাধ্যমতো আটকেপড়া এসব ভারতীয় ট্রাকচালকদের খাদ্য সহায়তাসহ অন্যন্য সহায়তা দিচ্ছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের খোঁজ রাখছি।’
গত ৪ এপ্রিল পাটবীজ নিয়ে আসার পর বাংলাদেশি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ওই দিনই ট্রাক খালি করে সেগুলো ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু, ভারতে লকডাউন চলায় ফেরার সময় বাধা দেয় ভারতের চ্যাংরাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তখন থেকে ৬১টি ভারতীয় ট্রাক আটকে আছে বুড়িমারী স্থলবন্দরে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ‘ভারতীয় দূতাবাস ও কোচবিহারের ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, তাদের কোনো সাড়া নেই। করোনা পরিস্থিতিতে আটকেপড়া ট্রাকচালকদের স্থলবন্দরের ইয়ার্ডে রাখা হয়েছে। তারা যেন কাস্টমস ইয়ার্ডের বাইরে যেতে না পারেন সেজন্য নজর রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।’
Comments