করোনা: যুক্তরাজ্যের ব্যর্থতা নিয়ে ৩ প্রশ্ন
ইউরোপের যে কয়টি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম যুক্তরাজ্য৷
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে মোট আক্রান্ত এক লাখ ৭২ হাজার ৪৮১ জন এবং মারা গেছেন ২৬,৮৪২ জন৷ এমনকী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের ব্যর্থতা নিয়ে মূলত তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন সমালোচকরা। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
আক্রান্ত হওয়ার পর সেলফ আইলোশনে থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস এক ভিডিওবার্তায় ব্যাপকভাবে করোনা পরীক্ষা করার আশ্বাস দেন। ব্রিটিশ সরকার জানায়, এপ্রিলের মধ্যেই প্রতিদিন ১ লাখ করোনা পরীক্ষা করা হবে। গত ২৮ এপ্রিল দেশটিতে মোট পরীক্ষা হয়েছে ৫২ হাজার ৪২৯।
ডাউনিং স্ট্রিট বলছে, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে দিনে ৭৩ হাজার পরীক্ষার সক্ষমতা আছে।
সংবাদমাধ্যমে ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) কর্মীদের করোনা পরীক্ষার পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে ব্রিটিশ সরকার।
করোনা প্রার্দুভাবের শুরুতে এনএইচএস কর্মীসহ প্রতিটি আক্রান্তের সংস্পর্শে আসাদের খুঁজে বের করে তাদেরকে নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করে আসছিলেন স্বাস্থ্যবিভাগের কর্মকর্তারা। কেন এই নিয়মটি পরে বন্ধ করা হলো এই প্রশ্নের কোনো সুস্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি দেশটির সরকার।
করোনা মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের সমালোচনায় বারবার তিনটি প্রশ্ন উঠে এসেছে।
সরকারের কি টেস্টিং কিট ফুরিয়ে গিয়েছিল?
অতিরিক্ত চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে কি আগের ব্যবস্থাটি তাল মেলাতে পারছিল না?
এটা কি যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রের যে এককেন্দ্রিক কাঠামো রয়েছে তা মেনে চলার জন্য করা হয়েছে?
রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিনের কর্মকর্তা গ্যাব্রিয়েল স্ক্যালি বলেন, ‘পরীক্ষা সীমিত করার কারণে ভাইরাসটি অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যদি পরীক্ষা করার সক্ষমতা না থাকে তাহলে মহামারি কোন পর্যায়ে আছে তা বোঝার উপায় থাকে না।’
ওইসময় ব্যবস্থাটি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কেবল কয়েকটি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা হত। স্থানীয় হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার সুযোগ ছিল না।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ব্রিটেনের এক শীর্ষ মাইক্রোবায়োলজিস্ট সিএনএনকে বলেন, ‘দুঃখজনকভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে করোনা মোকাবিলায় সরকারের যে মডেল তা চরমভাবে ব্যর্থ। আমাদের করোনা পরীক্ষার সক্ষমতা আসন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধারে কাছেও নেই। তারা যে কী ভাবছেন তা কেবল ঈশ্বরই জানেন। শুরুতে হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি মারাত্মক ভুল ছিল।’
এদিকে, তথ্য গোপনীয়তাবিষয়ক আইনের কারণে স্পষ্টভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গণমাধ্যমে জানাতে রাজি নয় ব্রিটিশ সরকার।
গত ১২ মার্চ ব্রিটিশ সরকার সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়। গণমাধ্যমে ওইদিন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে আরও পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারাতে চলছে।’
যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাস মোকাবেলায় দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হওয়ার ঘোষণা দিলেও তখনও দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়নি। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে সমালোচকদের কাছে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন।
ইংল্যান্ডের সামাজিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী প্রতি বছরের মতো এবারও চেলটেনহ্যাম রেসকোর্সে বার্ষিক উৎসব পালন করা হয়। প্রায় ১০ হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বরিস বলেন, ‘এসময় বিজ্ঞানের নির্দেশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের অনুষ্ঠান বাতিল করার মতো মহামারি ও মেডিকেল পরিস্থিতি ততটা প্রকট হয়নি।’
যদিও চিফ মেডিকেল অফিসার অধ্যাপক ক্রিস উইটি তখন বলেছিলেন যে, কারো শরীরে হালকা উপসর্গ থাকলেও তিনি অন্যের শরীরে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন।
সেসময় বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্যটি দেন ব্রিটেনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা প্যাটরিক ভ্যালান্স। তিনি বলেন, ‘মূল লক্ষ্য হলো সংক্রমণ কমানোর জন্য মানুষের মধ্যে শক্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (হার্ড ইমিউনিটি) তৈরি করা।’
তার মতে সরকারের লক্ষ্য ছিল বিস্তৃত আকারে এবং ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়ালে অনেক মানুষ আক্রান্ত হবেন। আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে উঠলে তারা করোনাভাইরাস-প্রতিরোধী হয়ে উঠবে। ফলে সংক্রমণের হার কমবে।
প্যাটরিক ভ্যালান্সের এমন বক্তব্যের পর গোটা বিশ্বেই ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনা শুরু হয়। যদিও সরকারি কর্মকর্তারা পরে জানান, এমন কোনো লক্ষ্য কখনোই সরকারি নীতিতে ছিল না।
গত ২৩ মার্চ দেশটিতে করোনায় ৩৩৫ জনের মৃত্যুর পর লকডাউনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী বরিস। কেন এ সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়নি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
Comments