মে দিবস

চা বাগানে শিশু শ্রমিক প্রায় ১৯ শতাংশ

যেহেতু তার মা মারা গেছেন, তার বাবা আবার বিয়ে করেছেন এবং ১২ বছর বয়সী মেয়ে শিউলি মুণ্ডাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন, সেহেতু সে তার ৬০ বছর বয়সী দাদি নিবন্ধিত চা-শ্রমিক বেলমনিকে নিয়ে এখন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার এক চা-বাগানে পাতা তুলছে।
Tea Labour Child.jpg
চা বাগানে শিশু শ্রমিক। ছবি: স্টার

যেহেতু তার মা মারা গেছেন, তার বাবা আবার বিয়ে করেছেন এবং ১২ বছর বয়সী মেয়ে শিউলি মুণ্ডাকে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন, সেহেতু সে তার ৬০ বছর বয়সী দাদি নিবন্ধিত চা-শ্রমিক বেলমনিকে নিয়ে এখন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার এক চা-বাগানে পাতা তুলছে।

‘আমি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। দাদি বলেছিলেন, তিনি আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারবেন না। আমি যদি কিছু উপার্জন করতে পারি, তবে পরিবারের জন্যে ভালো হবে,’ বলেছিল শিউলি মুণ্ডা।

শিউলি এখন বেলমনিকে তার প্রতিদিনের ২০-২৫ কেজি চা পাতা তুলতে সহায়তা করে।

একই বাগানে, ১৬ বছর বয়সী সখিনা মুণ্ডা ৭ম শ্রেণিতে এসে পড়ালেখা ছেড়ে দুই বছর আগে পাতা তোলা শুরু করে।

‘এই বাগানের এক নিবন্ধিত কর্মী আমার মা যক্ষায় ভুগছেন। কয়েক বছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন। আমাদের চার সদস্যের পরিবারকে খাওয়ানোর জন্য আমাকে এখানে কাজ করতে হয়,’ বলছিল সখিনা মুণ্ডা।

অন্যান্য চা-শ্রমিকদের মতো সেও দিনে কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা কাজ করে।

বৈশ্বিক মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) অংশ হিসেবে বাংলাদেশ অংশের জরিপ গত বছর সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ। অর্থায়ন করেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)।

জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরির কাজ গতবছর শেষ হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে পাঁচ বছর থেকে ১৭ বছরের কম বয়সী শিশুশ্রমের হার ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের বৈশ্বিক মাল্টিপল ইনডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের (এমআইসিএস) তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি জরিপে এ হার দেখানো হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

হবিগঞ্জে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত চা-বাগানের শিশুরা ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সিলেটে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।

দেশের চা-বাগানের ওপর এ ধরণের প্রথম গবেষণা ইউনিসেফের গ্লোবাল মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) প্রোগ্রামের আওতায় পরিচালিত হয়েছিল।

সিলেট বিভাগের চা-জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রথমবারের মতো আলাদা জরিপ করা হয় গত বছর। ইউনিসেফের সহযোগিতায় বিবিএস পরিচালিত এ জরিপের ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সিলেটের চা-বাগানের শিশুদের অপুষ্টির ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপের ফল বলছে, চা-বাগানের পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ খর্বকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প মজুরি, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও মাতৃত্বকালীন সেবার অপ্রতুলতায় পুষ্টিহীনতায় ভুগছে চা-শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। এর প্রভাব বেশি পড়ছে শিশুদের ওপর। খর্ব ও শীর্ণকায় হয়ে বেড়ে উঠছে তারা।

‘আমরা চাই না আমাদের শিশুরা তাদের অল্প বয়সেই কাজের সঙ্গে জড়িত হোক। আমরা তাদের স্কুল পাঠাতে ও তাদের শিক্ষিত করতে চাই। আমাদের সামর্থ নেই। কেননা, আমরা তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি না,’ বলছিলেন মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার চা-শ্রমিক অজিত ব্যানার্জি।

‘যেখানে দেশে মোট ৬ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুশ্রম পাওয়া গেছে, সেখানে চা-বাগানে শিশুশ্রম ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ,’ যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পঙ্কজ কন্দ বলেন, ‘আইন অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের চা-বাগানে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে বাগানের ক্ষেত্রে এটি নিয়মিত ঘটনা। সাধারণত ছেলে শিশু শ্রমিকরা চা-বাগান পরিষ্কার করে এবং চা গাছের যত্ন নেয়। মেয়ে শিশু শ্রমিকরা চা-পাতা তোলে। কখনও কখনও মেয়ে শিশুদের বস্তায় চা রাখার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। চা-মৌসুমে শিশুশ্রমের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। শ্রমিকরা চা-পাতা তোলার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে শিশুদের কাজে লাগায়।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের সিলেট বিভাগীয় শাখার আহব্বায়ক ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, দারিদ্রের কারণে চা-শ্রমিকদের অনেকেই বাগানে শিশুদের নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

সিলেট বিভাগ কার্যালয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) যুগ্ম-পরিচালক মুহাম্মদ আতিকুল কবিরের মতে, শিশুরা মূলত পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে জড়িত।

চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছিল। আমরা এই প্রতিবেদনটি গ্রহণ করিনি। তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই জরিপ করেছে।’

বাংলাদেশ চা সংসদের চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন, ‘আমরা কোনো শিশুকে নিয়োগ দিই না।’ জরিপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চা-বাগানে যারা শিশুদের নিয়োগ দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Comments