তামাক কোম্পানির প্রতারণায় ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না চাষি

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি হাট। ছবি: স্টার

লালমনিরহাটে রয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকার তামাকের বাণিজ্য। নিয়ম অনুযায়ী এ টাকা কৃষকের ঘরে যাওয়ার কথা। কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না। কৃষকরা পাচ্ছেন যৎসামান্য আর বেশির ভাগ যাচ্ছে তামাক কোম্পানি ও তাদের দালালদের পকেটে। সরকারিভাবে তামাকের একটি নির্দিষ্ট দাম ধরা থাকলেও তা তোয়াক্কা না করে কম দামে তামাক কেনা হচ্ছে কৃষকদের কাছ থেকে। নগদ টাকার প্রয়োজন হওয়ায় কৃষকরাও বাধ্য হচ্ছে কম দামে তামাক বিক্রি করতে।

আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি গ্রামের তামাক চাষি নুরুজ্জামান মিয়া (৫৫) জানান, তামাক চাষ ক্ষতিকর জেনেও লাভের আশায় কৃষকরা এ বিষবৃক্ষ চাষ করেন। কিন্তু এ বছর তাদের লাভের আশায় গুড়ে বালি। করোনাকে পুঁজি করে তামাক কোম্পানিগুলো কম দামে তামাক কিনতে প্রতারণার জাল ফেলেছে। আর টাকার প্রয়োজন হওয়ায় কৃষকরাও বাধ্য হয়েই প্রতারণার জালে আটকা পড়ছেন।

তিনি বলেন, ‘টাকার প্রয়োজন হওয়ায় হামরা কম দামে তামকু বেচবার নাগছি। তামকু কোম্পানিগুলা হামাক মিথ্যা কথা কয়া তামকু আবাদ করে নিছে।’ (টাকার প্রয়োজন হওয়ায় আমরা কম দামে তামাক বিক্রি করছি। তামাক কোম্পানিগুলো মিথ্যা বলে তামাক চাষ করিয়ে নিয়েছে।)

একই গ্রামের তামাক চাষি আশরাফুল ইসলাম (৪৮) জানান, এমনিতেই তামাকের দাম কম। তার উপর আদিতমারী উপজেলার সাপ্টিবাড়ি হাটে কৃষকদের কাছ থেকে মন প্রতি তামাকে খাজনা আদায় করা হচ্ছে আশি টাকা। এ যেন মরার উপর খরার ঘা। অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হামরা চাষি। হামারগুলার যত বিপদ আপদ। তামাক কোম্পানি হামাক কয়াছিল যে হামার কাছ থেকে সঠিক দামে তামাক কিনে নিবো আর এ্যালা করোনার ভয় দেখিয়ে কম দামে কিনবার নাগছে।’ (আমরা চাষি। সব বিপদ আপদ আমাদের। আমাক কোম্পানি আমাকে বলেছিল সঠিক দামে তামাক কিনে নেবে, আর এখন করোনার ভয় দেখিয়ে কম দামে কিনছে।)

একই উপজেলার সারপুকুর গ্রামের তামাক চাষি নজরুল ইসলাম জানান, গত বছর প্রতি মণ তামাক তিন হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু একই তামাক এ বছর বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা মণ। করোনার জন্য বাইরে থেকে পাইকার আসছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘হামরা এ বছর তামাক চাষ করি পড়ি গেছোং। তামাক কোম্পানিগুলা হামার সঙ্গে প্রতারণা করছে।’ (আমরা এবছর তামাক চাষ করে পরে গেলাম। তামাক কোম্পানিগুলো আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।)

সাপ্টিবাড়ি হাটের তামাক ফড়িয়া (দালাল) নবির হোসেন (৫২) জানান, তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে তামাক কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, কোম্পানিগুলোও কমদামে তামাক কিনছে। তিনি বলেন, ‘তামাক কোম্পানির দেওয়া দাম অনুযায়ী আমরা চাষিদের কাছ থেকে তামাক কিনছি। গত বছর কোম্পানির দেওয়া দাম ভালো ছিল, তাই ন্যায্যমূল্যে কৃষকের তামাক কিনেছিলাম।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লালমনিরহাটে একটি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধি জানান, মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী তারা তামাক কিনছেন। জেলায় ছয়টি তামাক কোম্পানি কৃষকদের কাছ থেকে তামাক কিনছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে হয়তো মালিকরা এ বছর তামাক কিনতে কম রেট দিয়েছে।

জেলা বিপণন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকারিভাবে নন গ্রেড প্রতি কেজি তামাকের দাম ৯২ টাকা ধার্য করে দিলেও কোম্পানিগুলো তা কিনছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। দু-একটি কোম্পানি ছাড়া সবগুলো কোম্পানির একই চিত্র। হাটগুলোতেও কোম্পানির দালালরা তামাক কিনছেন আরও কম দামে। নিয়ম অনুযায়ী তামাক চাষিদের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাসহ মাস্ক বিতরণ করবে কোম্পানিগুলো। কিন্তু, তা তারা করছে না। আর ওজনেও রয়েছে কারচুপি। লালমনিরহাট জেলায় গড়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার তামাকের বাজার রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো বাজার এখন তামাক কোম্পানি ও তাদের দালালদের নিয়ন্ত্রনে।’

বিষবৃক্ষ তামাক চাষ করে দুর্বিপাকে ঘুরপাক খাচ্ছেন চাষিরা। আর তামাকের হাজার কোটি টাকার বাজারে লুটতরাজের রাজত্ব করছে কোম্পানিগুলো।

সরকারি দরে তামাক ক্রয় করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।

Comments

The Daily Star  | English

Polls could be held in mid-February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus has said the next general election could be held in the week before the start of Ramadan in 2026.

2h ago