কাজলের জন্য ন্যায় বিচার

কাজলের দুঃস্বপ্নের শুরু হয় দৈনিক মানব জামিনের একটি প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করার মাধ্যমে। গত ২ মার্চ যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানব জামিন। এতে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া এমন অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন যারা তাকে সাহায্য করেছেন বা যাদের মাধ্যমে তিনি উপকৃত হয়েছেন।
ছবি: সংগৃহীত

সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়েরের পরদিন ১০ মার্চ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজ হন। সেদিন সন্ধ্যায় হাতিরপুলের অফিস থেকে বের হওয়ার সময় অফিসের নিচে রাখা তার মোটরসাইকেলের আশেপাশে কয়েকজনকে সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে সিসিটিভি ফুটেজে। কাজলের বাসা চকবাজার থানার আওতাধীন এবং তার অফিস নিউ মার্কেট থানার আওতাধীন। তিনি নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার মামলা করতে গেলে দুটি থানার একটিও মামলাটি নিতে চায়নি। অবশেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চক বাজার থানা মামলাটি নেয়। তিনি ৫৩ দিন নিখোঁজ ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তদন্ত করছি বলা ছাড়া আর কিছুই করেনি পুলিশ। দেশের একজন নাগরিক, একজন সাংবাদিক, একটি পরিবারের সদস্য, একজন বাবা, একজন স্বামী, একজন করদাতা-কোনো পরিচয়ই তাকে উদ্ধার করতে উদ্বুদ্ধ করেনি পুলিশকে।

গত রোববার আমাদের জন্য স্বস্তি এবং কাজলের পরিবারের জন্য আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে রাত ২টা ৪৮ মিনিটের আকস্মিক একটা ফোন কল। বেনাপোল থানার সহযোগিতায় ফোনে কাজল তার ছেলে মনোরম পলককে জানান, তিনি বেঁচে আছেন। পলক যেন তাকে নিতে বেনাপোল চলে আসে।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে কাজলকে ‘খুঁজে’ পায় বিজিবির একটি টহল দল। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। বেনাপোল পুলিশ তাকে শনাক্ত করে, তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাকে অবৈধভাবে পাসপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা করে। এই মামলার শাস্তি পাঁচ শ টাকা জরিমানা বা তিন মাসের জেল।

তার আকস্মিক উপস্থিতির খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট নাগরিকরা প্রতিটি মুহূর্তের খবর নিচ্ছিলেন। সবাই উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষায় ছিলেন কাজলের মুক্তি এবং পরিবারের কাছে ফিরে যাবার। সকলেই ভেবেছিলেন মামলার আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে আদালতে হাজির হতে হবে তাকে। সহজেই জামিনে মুক্ত হয়ে যাবেন কাজল।

তবে, কাজলকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন সবাইকে হতবাক করে দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে তার দুহাত পিছনে নিয়ে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা ছিল। কাজলকে হাতকড়া পরানের কোনো কারণই ছিল না। পুলিশ সাধারণত সন্ত্রাসীদের কিংবা হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, ফৌজদারি মামলা বা এ ধরনের সহিংস অপরাধে অভিযুক্তদের হাতকড়া পরিয়ে থাকে। ৫৩ দিন ধরে নিখোঁজ থাকা কাজল এর কোনোটিই নন।

গল্প এখানেই শেষ না। হাতকড়া পরানোর অপমান সহ্য করে কাজল আদালতে হাজির হয়ে অনুপ্রবেশের মামলায় জামিন পান। জামিনে বের হয়ে তার ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পুলিশ তাকে আবার গ্রেপ্তার করে। কারণ, ঢাকায় তার বিরুদ্ধে কঠোর ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকটি মামলা রয়েছে।

কাজলের দুঃস্বপ্নের শুরু হয় দৈনিক মানবজমিনের একটি প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করার মাধ্যমে। গত ২ মার্চ যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়াকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানবজমিন। এতে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া এমন অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন যারা তাকে সাহায্য করেছেন বা যাদের মাধ্যমে তিনি উপকৃত হয়েছেন। প্রতিবেদনে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে কাজলসহ অনেকেই তাদের ফেসবুক পেজে এই প্রতিবেদনটি শেয়ার করেন ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর এবং আরও কয়েকজনের নামসহ। এ কারণে সাইফুজ্জামান শিখর ৯ মার্চ মানবজমিনের সম্পাদক ও প্রতিবেদকসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এই ৩২ জনের মধ্যে কাজলের নাম ছিল প্রথমে। মামলা দায়েরের পরদিনই নিখোঁজ হন তিনি।

কাজলের জন্য নিকট ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে? যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা আছে বলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে রাখা হচ্ছে। যাতে সংশ্লিষ্ট আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে এবং তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারে। তাকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে, যেখানে তিনি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন।’

তার এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে ৫৪ ধারায় তাকে আটক করা হয়েছে যাতে অন্য মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায়। এটি হাইকোর্ট বিভাগের ১৪ বছরের পুরানো রায়ের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যে রায়টি ২০১৬ সালে আপিল বিভাগ বহাল রাখে। এই রায়ে কোন ক্ষেত্রে ৫৪ ধারা প্রয়োগ করা যাবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া আছে। যশোর কোতোয়ালি থানা পুলিশ ৫৪ ধারা যেভাবে ব্যবহার করেছে তা আপিল বিভাগের এই গাইডলাইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। পরিবারের সূত্রে জানা যায়, মহামারির কারণে আদালত বন্ধ থাকায় তার জামিনের জন্য আবেদন করা যাচ্ছে না।

আমাদের আইন এমন যে ৫৩ দিন ধরে নিখোঁজ একজন ফটো সাংবাদিককে খুঁজে বের করার জন্য কোনো তোড়জোড় হয় না। এখন যখন তার খোঁজ পাওয়া গেছে তখন হঠাৎ আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাকে বিভিন্ন আইনে কারাগারে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে এবং তার মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও তাকে বঞ্চিত করছে। আদালত এক আইনে জামিন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্য আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে শুধু আটকে রাখা হয়েছে এবং তার স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে তাই নয়, হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে অপমান-অসম্মান করা হয়েছে। তার সঙ্গে অপরাধীদের মতো আচরণ করা হয়েছে। কোয়ারেন্টিনের রাখার কৌশলে তাকে মিলিত হতে দেওয়া হয়নি পরিবারের সঙ্গেও।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার সঙ্গে যা করছে তা দৃশ্যমান হয়েছে। এখন আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতায় পড়ছে কাজলের পরিবার। আদালত বন্ধ থাকায় তারা জামিনের আবেদন করতে পারছেন না। আবার তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর প্রক্রিয়া চলছে।

তাহলে, আদালত বন্ধ থাকলে কি ন্যায়বিচার পাওয়া বন্ধ থাকবে? আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করছি, যতক্ষণ সংবিধান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর দ্বারা অনুমোদিত সব মৌলিক অধিকার সবার প্রাপ্য। তাহলে আদালত যখন বন্ধ থাকে তখন মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার কি হবে? সাধারণত যখন মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হয় তখনেই একজন নাগরিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। এমনকি সাধারণ অবকাশের সময়ও জরুরি বিষয় দেখার জন্য আদালতের অবকাশকালীন বেঞ্চ থাকে।

তাহলে, কাজলকে কি তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কারাগারে পচতে হবে? আর এর কারণ কি করোনাভাইরাসের কারণে আদালত বন্ধ থাকা? ‘বিচার দেরি করার অর্থ হলো বিচার থেকে বঞ্চিত করা’- পুরনো এই প্রবাদটি যদি আমরা বিশ্বাস করি, তাহলে আদালত বন্ধ থাকার কারণে বিচার পেতে যে দেরিটা হচ্ছে তা কাজলের মতো মানুষদের প্রাপ্য নয়।

আমরা উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন করছি, অনুগ্রহপূর্বক মৌলিক অধিকারের মামলাগুলো সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করুন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ১০৪ অনুচ্ছেদের ‘পূর্ণ ন্যায়বিচার’ এর ধারণাটি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আদালত প্রত্যক্ষভাবে কার্যপরিচালনা করতে না পারলে আমাদের পরামর্শ থাকবে এর জন্য নতুন কোনো পদ্ধতি আমলে নেওয়ার। যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়। সেক্ষেত্রে ভার্চুয়াল কোর্টের ধারণা নেওয়া যেতে পারে। যা ইতিমধ্যে ভারতে শুরু হয়েছে। আর কেনই বা এটা করা হবে না, পুরো দেশের মতো আদালতেরও ডিজিটাল হওয়া উচিত এবং সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে, যদি সীমাবদ্ধতা না থাকে তাহলে বিচার ব্যবস্থা জনগণের আরও কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।

আমরা প্রধান বিচারপতির দপ্তরে আবেদন করছি যেন কাজলের মামলাটি তার আমলে নেন এবং কাজল যেন তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পান।

পুনশ্চ: বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে ফটো সাংবাদিক কাজলকে হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে অসম্মান করা হলো। কি নির্মম পরিহাস!

মাহফুজ আনাম, দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক

Comments

The Daily Star  | English

BPL: Local retentions and direct signings confirmed

In a surprising move, Sylhet Strikers preferred to retain Zakir Hasan and Tanzim Hasan Sakib instead of going for Mashrafe bin Mortaza.

14m ago