মহামারির ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন

আহমেদাবাদ, ভারত। ৭ মে ২০২০। ছবি: রয়টার্স

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সারা পৃথিবীতে ৪০ লাখের কাছাকাছি মানুষ নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত। মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামনো যাচ্ছে না!

এত ক্ষুদ্র অস্তিত্বের এমন ভয়াল থাবা বর্তমান পৃথিবীর কোনো মানুষ (কিছু শতবর্ষী মানুষ ছাড়া) জীবদ্দশায় দেখেননি। যদিও মহামারির এমন ভয়াবহ চিত্র পৃথিবীতে আগেও দেখা গেছে। এইতো গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯১৮ সালে লোমহর্ষক ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারিতে পৃথিবীর প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছিল।

একশ বছর পর দুনিয়াতে আবার সেই একইরকম ভয়াল সংক্রামক রোগের মহামারি হানা দিল ২০১৯ সালে! অতীতে মানুষ কীভাবে বিশ্ব-মহামারি মোকাবিলা করেছে? মহামারি পরবর্তী বিশ্বই বা কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল? অতীতে বিশ্ব-মহামারির প্রকোপ ও তৎপরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সার্বিক সমাজ ব্যবস্থায় যে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল সেখান থেকেও অনেক কিছু শিখতে পারি আমরা।

পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ যেমন বহুকালের, সংক্রামক রোগের মহামারির ইতিহাসও সেরকম অনেক প্রাচীন। সময়ের বিবেচনায় বলতে গেলে প্রথমেই আসে ‘এথেনিয়ান প্লেগ’র ইতিহাস। সেই ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই বিশ্ব-মহামারি ইথিওপিয়া থেকে উৎপত্তি লাভ করে ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর ও গ্রিসে।

দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এ মহামারিতে রোগের উপসর্গ ছিল কিছুটা ইবোলা ভাইরাসের লক্ষণের মতো তীব্র জ্বর ও রক্তবমিসহ অল্প কয়েকদিনের মধ্যে রোগীর মৃত্যু। উল্লেখ্য যে, ইবোলা ভাইরাস পৃথিবীতে প্রথম চিহ্নিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ সুদানে। ধারণা করা হয় গ্রিসের এক-তৃতীয়াংশ মানুষই এ মহামারির সময় সংক্রমিত হয়। বেশি সংক্রমিত হয় ডাক্তার ও রোগীর সেবা প্রদানকারীরা।

এথেনিয়ান প্লেগ মানুষকে এতোটাই প্রভাবিত করেছিল যে তারা ধর্ম বা নিয়মনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সমাজে শ্রদ্ধাবোধের রীতি বিনষ্ট হয়েছিল। মানুষ মৃত্যুভয়ে ছিল আড়ষ্ট।

তারপর কয়েক শতাব্দী পর, ১৬৫-১৮৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে পৃথিবীতে হানা দেয় ‘এন্টোনাইন প্লেগ’। চীনে উৎপত্তি হয়ে এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও মিশর, গ্রিস, ইতালিসহ সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যে সৈনিকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি।

ধারণা করা হয়, এ মহামারির কারণ ছিল গুটিবসন্তের জীবাণু। সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই সংক্রমিত হয় এন্টোনাইন প্লেগে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে মানুষের অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয় তখন। যার ফলস্বরূপ রোমান সাম্রাজ্যের পতনের গোড়াপত্তনও হয় তখন থেকেই। মহামারি পরবর্তী সময়ে খুব দ্রুত নতুন নতুন কুসংস্কার আর নতুন ধর্মের বিস্তার শুরু হয় সেসময়।

এরপর ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে আসে ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ মহামারি। এর নাম ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’। মহামারির নামকরণ হয় তখনকার রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে। এ মহামারির জীবাণু ছিল ‘Yersinia Pestis’ নামক ব্যাকটেরিয়া; যা ইঁদুর ও একধরণের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সট্যান্টিনোপলে।

খুব ক্ষিপ্রবেগে ছড়িয়ে পড়া এ রোগের উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া ও রক্তবমি। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে লোকালয়ে মানুষকে কবর দেওয়ার মতো জায়গা ছিল না! বিশালাকার গর্ত করে ৭০ থেকে ৮০ হাজার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত গর্তও সংকুলান না হওয়ায় শহরগুলির চারপাশে ভাগাড়ের মতো লাশের স্তূপ জমে ছিল। রাস্তাঘাট মরুভূমির মতো জনশূন্যে পরিণত হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভীষণ খাদ্য সংকটে না খেতে পেয়ে অসংখ্য মানুষ মারা গিয়েছিল।

শুরুটা ৫৪১ সালে হলেও বছরান্তে চক্রাকারে এ মহামারি চলতে থাকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মোট আড়াই কোটির বেশি মানুষ মারা যায় এ মহামারিতে। ধারণা করা হয় ইউরোপের অর্ধেক মানুষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এ সময়।

আবার, প্রায় ৬০০ বছর পর ১৩৩৪ সালে চীনে দেখা দেয় ‘বিউবনিক প্লেগ’ যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ হিসেবে পরিচিত। এ মহামারির জীবাণুও ছিল ‘Yersinia Pestis’ নামক ব্যাকটেরিয়া যা ইঁদুর ও একধরণের মাছির মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিল। উপসর্গ ছিল জ্বর, বিষফোঁড়া, রক্তবমি ও নিউমোনিয়া। সংক্রমিত মানুষের প্রায় ৫০ শতাংশই মারা গিয়েছিল।

শুরুটা চীনে হলেও মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশ পাড়ি দিয়ে ১৩৪৭ সালে প্রথম ইতালির সিসিলি হয়ে সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এই মহামারি। সারা বিশ্বে পঞ্চাশ বছর ধরে এ মহামারির তাণ্ডব চলে ১৫০ মিলিয়ন মানুষ পৃথিবী থেকে মুছে যায়! তখন বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে কমে ৩০০ মিলিয়নে নেমে আসে। মৃত্যুভয় ও আতঙ্কে মানুষ বিভিন্ন কুসংস্কার আর ধর্মীয় কোন্দলে জড়িয়ে পরে। শ্রমিক সংকটে পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় থেমে যায়। ফলে সমাজে ধনী-গরিবের শ্রেণিবিন্যাস বদলে যায়। অনেক ধনী মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যায়। আবার অনেক গরিব মানুষ ধনী হতে শুরু করে। এভাবে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয় এ মহামারি-পরবর্তী সময়ে।

‘ব্ল্যাক ডেথ’র সময় থেকেই কোয়ারেন্টিন ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত সংক্রামক রোগের মহামারি নিয়ন্ত্রণে কোয়ারেন্টিনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বিশ্বব্যাপী।

বর্তমান সময়ের নিকটতম অতীতের সব থেকে ভয়াবহ মহামারির নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। যাকে বলা হয় ‘সব মহামারির জননী’। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিশেষ জাত H1N1 দ্বারা সংক্রমণকারী এ মহামারিই ছিল আসল বিশ্ব-মহামারির দৃষ্টান্ত। মানুষ-শুকর-পাখি এই তিন সম্ভাব্য প্রাণী থেকে উৎপত্তি হওয়া H1N1 ভাইরাস ১৯১৮ সালের শুরু থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে সংক্রমণ করে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মানুষকে। আর প্রাণ কেড়ে নেয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষের।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, স্পেন অথবা অস্ট্রিয়ার কোথাও উৎপত্তি হয়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। ঐতিহাসিক নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারির ভাইরাস জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে বারবার রূপ পরিবর্তন করে তিনটি ভিন্ন ধাপে আঘাত হানে। ১৯১৮ সালের মার্চে প্রথম ধাপে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে। প্রথম ধাপে সংক্রমণের গতি ছিল খুব ক্ষিপ্র। কিন্তু মৃত্যুহার ছিল অনেক কম। ছয় মাস পর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরু হলে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। এ ধাপে মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। বিভিন্ন দেশে তৃতীয় ধাপের সংক্রমণ শুরু হয় ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে।

‘স্প্যানিশ ফ্লু’ আক্রান্তদের বেশিরভাগই ছিল যুবক আর সুস্থ মানুষ। তবে সংক্রমিতদের মৃত্যুহার ছিল বেশি। অনেক বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মৃত্যুবরণ করেন। যদিও শুরুতে মানুষ অনেক আতঙ্কিত ও দিশেহারা ছিল। তবে মহামারি শেষ হওয়ার অল্পদিনের মধ্যে মানুষ সবকিছু ভুলে গিয়ে দ্রুত আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করে। এ জন্য ‘স্প্যানিশ ফ্লু’কে অনেক সময় বলা হয় ‘ভুলে যাওয়া মহামারি’।

উল্লেখিত মহামারিগুলোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে অন্তত এটুকু অনুমান করা যায় যে অতীতের সব মহামারির সঙ্গেই নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে। যেমন, ছড়িয়ে পড়ার গতি, সংক্রমণের ব্যাপকতা ও বৃহৎ ভৌগলিক অঞ্চলে সংক্রমণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া। তাই অতীতের ভালো-খারাপ দুই ধরণের দৃষ্টান্তই বর্তমানের জন্য হতে পারে দারুণ শিক্ষা। যা এই বিজ্ঞান-তথ্য-প্রযুক্তির অত্যাধুনিক পৃথিবীতে আমাদের জন্য হতে পারে পাথেয়। অতীতের মহামারিগুলো থেকে আমাদের এখন কী কী শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন তা আমি বিস্তারিত নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

১) অধিকাংশ সংক্রামক রোগের মহামারির উৎপত্তি হয়েছে পশুপাখি থেকে যেখানে মানুষ নিজেই বন্যপ্রাণীর বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে সংক্রামক রোগ মানবদেহে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াকে বেগবান করেছে। পশুপাখির ভূমিকা সবসময় ছিল গৌণ।

কোভিড-১৯ ও এর ব্যতিক্রম নয়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায় সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের প্রথম মানব সংক্রমণ হয়েছিল বন্য প্রাণী থেকে। কিন্তু, যে কারণে এটি বিশ্ব-মহামারির রূপ নিল তা হচ্ছে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া। এরপর থেকেই এ ভাইরাস বিস্তারে পশুপাখি হয়ে গেছে গৌণ, আর মানুষ হয়েছে মূখ্য। উল্টো মানুষ দ্বারা পোষা বিড়াল বা চিড়িয়াখানার বাঘ সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে অনেক দেশে। তাই অনেকে এখন প্রশ্ন করেন— বাংলাদেশে গবাদি প্রাণী বা ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া কি নিরাপদ? গবাদি পশুপাখির সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির কোনো সম্পর্ক নেই। বরং দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে দুধ-ডিম-মাংস খাওয়া খুব জরুরি। সব মহামারিকে কেন্দ্র করে নানান গুজব, কুসংস্কার ও ধর্মীয় দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির মানুষ লাভবান হতে চেয়েছে সবসময়। ফলস্বরূপ সংক্রমণ আরও বেগবান হয়েছে। তাই সচেতনতার জন্য মহামারির সময় সঠিক তথ্য সরবরাহ করা খুবই জরুরি।

২) সামাজিক দূরত্বই সংক্রমণ ছড়ানো রোধে সব থেকে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্লেগের সংক্রমণের চেয়ে শতগুণ দ্রুত ছড়িয়েছে ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। তার চেয়ে আরও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। এর অন্যতম কারণ হলো প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের চলাফেরার গতি আগের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় ভাইরাসও ছড়িয়েছে অল্প সময়ে বিস্তৃত জায়গায়। ১৯১৮ সাল আর এখনকার পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা, তখন মানুষের জানাই ছিল না যে ফ্লুর কারণ ছিল ভাইরাস। তারপরও তখন বেশিরভাগ জায়গায় স্কুল-কলেজ, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য সাময়িক বন্ধের মাধ্যমে সামাজিক-দূরত্ব তৈরি করা হয়েছিল।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র সময় যেসব জায়গায় সামাজিক-দূরত্ব নিয়ম কার্যকর ছিল সেখানে মহামারির প্রকোপ ও মৃত্যুহার ছিল অনেক কম। আবার এটাও দেখা গেছে, কিছু জায়গায় প্রথম দিকে সামাজিক-দূরত্ব নিয়ম কার্যকর থাকলেও হঠাৎ সব কিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে পরবর্তীতে ঐসব স্থানে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার হয়েছিল কয়েকগুণ বেশি।

হুবহু এই ভুলটাই বাংলাদেশেও হতে যাচ্ছে এখন! যুক্তিযুক্ত প্রস্তুতি ছাড়াই ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় গার্মেন্টস, শপিংমল, মার্কেট ও অনেক অফিস খুলে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলাফল ভয়াবহ হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। দীর্ঘদিন কর্মক্ষেত্র লকডাউনে রাখা যদিও অসম্ভব, আবার তড়িঘড়ি করে সবকিছু খুলে দিলে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার রোধ করাও অসম্ভব। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই ধীরে ধীরে জনজীবন উন্মুক্ত করে দেওয়াটাই হবে যৌক্তিক। তাই এ মুহূর্তে সব থেকে বেশি প্রয়োজন স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো আরও বৃদ্ধি করা ও দ্রুত রোগ শনাক্ত করার প্রক্রিয়াকে প্রশস্ত করা।

কার্যকর ভ্যাকসিন আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের মাধ্যমে সংক্রমিত মানুষকে আইসোলেশন করাই এ মহামারি ঠেকানোর সব থেকে কার্যকর উপায়।

শুধু আরটি-পিসিআর টেস্টের উপর নির্ভর করলে হবে না। বিশাল সংখ্যক রেপিড টেস্টের মাধ্যমে দ্রুত শনাক্তকরণই মহামারি ঠেকাতে অনেক ভূমিকা রাখবে।

৩) জীবাণু মানুষের বয়স বা জাত চিনে না। অতীতের মতো কোভিড-১৯-ও বয়স বা জাতের বিচারে সংক্রমণ করেনি। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, যুবক-বৃদ্ধ, কেউ বাদ যায়নি। তাই, অল্পবয়সীদের এ কথা ভাবার সুযোগ নেই যে তাদের সংক্রমণের সম্ভবনা কম। ধনীদের মনে করার দরকার নেই যে তারা বেঁচে যাবে। এ সমস্যা সবার জন্য। তাই সবাইকে মিলিতভাবে মহামারি ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে। একক প্রচেষ্টায় কোনো মহামারিকেই ঠেকানো যায়নি।

কোনো মহামারিই শুধু এক শ্রেণির পেশাজীবী দ্বারা মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। সমাজের সবস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া সংক্রামক রোগের মহামারি মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। ডাক্তার-নার্সের সেবা যেমন জরুরি তেমনি গবেষকদের গবেষণা, পুলিশ ও প্রশাসনের নজরদারি, ব্যাংক সচল রাখা বা কৃষকের শস্য উৎপাদনও জরুরি। সব পেশাজীবীদের যৌথ অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ মহামারি মোকাবিলা করতে হবে। তাদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। তা না হলে যারা ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা, তারাও দ্রুত আক্রান্ত হয়ে পড়বেন যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে।

৪) সব সংক্রামক রোগের মহামারির অল্প কিছুদিনের অন্তরায় দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড খাদ্যঘাটতি ও মাত্রাতিরিক্ত অপরাধ প্রবণতা। করোনাভাইরাস মহামারিতেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে বিভিন্ন গবেষক-বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন। তাই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য লকডাউন যেমন জরুরি তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ শস্য ও প্রাণিজ আমিষ উৎপাদন যাতে থেমে না যায় সেদিকে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে বিশেষ নজরদারি রাখাও জরুরি।

উন্নত দেশেও ইতোমধ্যে খাদ্যের ওপর মহামারির প্রভাব শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে উপযুক্ত বাজারজাতকরণ ও শ্রমিকের অভাবে খামারিরা লাখ লাখ মুরগি খামারেই মেরে ফেলছে। বাংলাদেশেও পোল্ট্রি ব্রিডার কোম্পানিগুলো লাখ লাখ বাচ্চা পানির দরে বিক্রি করতেও হিমশিম খাচ্ছে। হাজার হাজার প্রান্তিক খামারি, মৎস্য ব্যবসায়ী, ডেইরি উদ্যোক্তা ইতোমধ্যে পথে বসার উপক্রম! সময়মতো এসব কৃষিজ ও প্রাণিজ শিল্পকে রক্ষার জন্য সঠিক ভূমিকা গ্রহণ না করলে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিবে। ফলশ্রুতিতে মানুষকে না খেয়ে মরতে হবে।

কৃষিজ পণ্য দ্রুত-পচনশীল, উৎপাদন শেষে দিনে দিনে বাজারজাত করতে হয়। অন্য অপচনশীল দ্রব্যের মতো চাইলেই এক-দুই মাস অপেক্ষা করা যায় না। তাই এসব খামারিসহ দেশের লাখ লাখ উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে দরকার মাল্টি-সেক্টরিয়াল প্ল্যান।

এছাড়া, বাংলাদেশে খেটে খাওয়া ও অল্প আয়ের মানুষদের অবস্থাও শোচনীয়। ত্রাণ ও রেশন বিতরণে স্বচ্ছতা আনা খুবই জরুরি। একজন অসহায় লোক সরকারি-সহায়তা পাবেন, আরেকজন পাবেন না তা স্পষ্ট খেয়াল রাখা জরুরি। পক্ষপাতিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ত্রাণ ও রেশন বিতরণে।

জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে তার এলাকার মানুষের জন্যে কায় মনে কাজ করতে হবে। সঠিকভাবে এসব নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত ডাটাবেস তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে ত্রাণ ও রেশন বিতরণ বেগবান করা। পাশাপশি সবার অধিকার ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।

৫) কোন মহামারিই রাতারাতি শেষ হয়নি। দুই-তিন বছর, এমনকী একাধিকবার আঘাতসহ যুগ যুগ ধরে চলেছে এর প্রকোপ। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের ধরন ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে সহজেই অনুমেয় যে এটিও রাতারাতি শেষ হবে না। তাই, প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই দীর্ঘমেয়াদী মহামারি মোকাবিলা পরিকল্পনা প্রয়োজন।

সংক্রামক রোগের মহামারিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভাবা মস্ত ভুল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের হাত থাকে না। কিন্তু সংক্রামক রোগের মহামারির বিস্তার নির্ভর করে মহামারি মোকাবিলার প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতির ওপর। যে দেশ যত দ্রুত মহামারি মোকাবিলা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সে দেশে তত কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মহামারিতে একটি বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। মহামারির শুরুতে অস্ট্রেলিয়া সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। যার ফলে সেখানে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার খুব কম। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় মোট সংক্রমণের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার, মৃত ৯৩ আর রিকভার করেছে প্রায় ছয় হাজার।

অপরদিকে, ইতালি মহামারি শুরুর অনেক পরে সাড়া দেওয়ায় নেমে আসে ভয়াবহ পরিস্থিতি। মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণের ফলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ফলশ্রুতিতে মূল্য দিতে হয়েছে অসংখ্য জীবনের। তাই সংক্রামক রোগের মহামারিকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ না ভেবে সরকারকে দ্রুত সচেষ্ট ভূমিকা নিতে হবে এটি মোকাবিলা করার জন্য।

অবশেষে বলতে চাই, সব মহামারিই একদিন শেষ হয়েছে। কোভিড-১৯-ও একদিন শেষ হবে। অতীতের অন্য মহামারির চেয়ে কোভিড-১৯ একদিক থেকে আলাদা। তা হলো: প্রযুক্তির বিকাশে শুরু থেকেই আমরা এই মহামারির ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি। যা অতীতের মহামারির ক্ষেত্রে ছিল অজানা। তাই আধুনিক বিজ্ঞান ও মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে এ মহামারি আগের মহামারিগুলোর চেয়ে দ্রুত থামানো যাবে এই আস্থা ও বিশ্বাস রাখাই যায়।

 

তথ্যসূত্র

১) Emerg Infect Dis. 2006 Jan, 12(1):15–22.

২) Mt Sinai J Med. 2009 Oct, 76(5):456-67

৩) Psychiatry of Pandemics. 2019 May, 16:7–35.

৪) Nature Medicine. 2020, 26:450–452.

 

ড. মো. জহুরুল ইসলাম, পোস্টডক্টরাল গবেষক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র ও সহযোগী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

No price too high for mass deportations

US President-elect Donald Trump has doubled down on his campaign promise of the mass deportation of illegal immigrants, saying the cost of doing so will not be a deterrent.

4h ago