বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিরা কোথায় যায়!
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এবার সারাবিশ্বের পাখিপ্রেমীরা এক ভিন্নধর্মী 'বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস' পালন করছে আজ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি হয়তো প্রকৃতির জন্য এবার আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় সারা পৃথিবীতে দূষণ কমেছে। বনভূমি এবং পর্যটন স্থানগুলোতে কমেছে লোকের আনাগোনা। যার ফলে প্রকৃতি তার নিজেকে সাজিয়ে নেওয়ার কিছু ফুরসত পেয়েছে। বাংলাদেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ছেয়ে গেছে সাগরলতায়, সৈকতের একেবারে কাছে দেখা গেছে বিরল জাতের ডলফিন। সেন্টমার্টিনে ফিরে এসেছে কচ্ছপের ঝাঁক। শান্ত পরিবেশে বনে বনে পাখিরা করছে অবাধ প্রজনন।ওপার বাংলার সুন্দরবনে বেড়েছে বাঘের সংখ্যা। তাছাড়া রাজশাহীর পদ্মার দুর্গম চরে পাওয়া গেছে ঘড়িয়ালের ডিমের খোসা যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক খবর।
আইইউসিএন, বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি রাকিবুল আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘প্রত্যেক বছর আমরা এই দিনটি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করতাম কিন্তু এবার মহামারির কারণে কিছুই করতে পারছি না শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু প্রচারণা ছাড়া।’
‘আমাদের বিশ্বকে একসূত্রে গাথে পাখি’ (Birds connect our world) এই স্লোগানে সারাবিশ্বে দিবসটি আজ পালিত হচ্ছে বলে তিনি জানান।
গত কয়েক বছর আইইউসিএন, মোট ৫৫টি পরিযায়ী পাখির গায়ে জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়েছে। এই পাখিগুলোর নামও দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন। তার মধ্যে কিশোয়া নামের একটি ছোট হাঁসের ৪৫৮ দিনের ভ্রমণ রেকর্ড করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ছোট এই পাখি এর মধ্যে বাংলাদেশে এসেছে কয়েকবার। থেকেছে টাঙ্গুয়ার হাওর এবং পদ্মা যমুনার চরে। চীন, ভুটান, ভারত এবং বাংলাদেশ এই চারটি দেশের মোট ৯,৫০৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে হাঁসটি, জানান আইইউসিএনের সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সরোয়ার আলম দিপু।
'এইভাবে অনেক পাখি আমাদের বিশ্বের সমস্ত দেশগুলোকে একটি বিশ্ব বাস্তুতন্ত্রে আবদ্ধ করে পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।'
আইইউসিএনের তথ্যানুযায়ী, প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের স্বাদু পানির হাওর-বাওর, বিল এবং জলাশয়গুলোতে দুই লাখেরও বেশি হাঁস এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বিচরণ করে, বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওর এবং হাকালুকি হাওরে। এছাড়া আরও এক লাখের বেশি সৈকতপাখি আমাদের সামুদ্রিক অঞ্চলে বেড়াতে আসে।
আইইউসিএন বন্য পাখিদের গতিপথ পরিদর্শন বুঝার জন্য যে ৫৫ টি পাখির (হাঁস) গায়ে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়েছে তার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে বাংলাদেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা দুটি নির্দিষ্ট আকাশ (flyways) পথ ব্যবহার করে। সারা বিশ্বে পাখিরা এমন নয়টি নির্দিষ্ট আকাশ পথ বা চলার পথ ব্যবহার করে থাকে।
বাংলাদেশে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি পরিযায়ী পাখি দেখা যায় যারা ইস্ট এশিয়ান অস্ত্রালাশিয়ান (East Asian- Australasian Flyway (EAAF) এবং সেন্ট্রাল এশিয়ান ফ্লাইওয়ে ব্যবহার করে ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, দক্ষিণ করিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ভ্রমণ করে। এ বছর ইতিমধ্যে পাঁচটি পাখি হিমালয় পাড়ি দিয়েছে। (ছবি- আইইউসিএনের মানচিত্র)। এই সব দেশে ঋতুভেদে কিছু কিছু জায়গায় পাখিগুলো কিছু দিনের জন্য অবস্থান করে। কোথাও বা খাবারের জন্য, কোথাও প্রজননের জন্য, আবার কোথাও বা বিরূপ আবহাওয়া থেকে বাঁচার জন্য পাখিগুলো এই ভাবে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করে।
আইইউসিএন, বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি রাকিবুল আমিন বলেন, 'পাখিদের গায়ে লাগানো এই স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটারগুলো থেকে আমরা জানতে পারি যে আমাদের দেশের অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়গুলোও বিশ্ব বাস্তুতন্ত্রে সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিযায়ী পাখিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই জলাশয় এখনো ভীষণভাবে অরক্ষিত এবং পাখিদের জন্য অনিরাপদ।
শুধুমাত্র আইনের প্রয়োগ কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করলেই কেবল আমরা পরিযায়ী পাখি এবং তাদের আবাসস্থল রক্ষা করতে পারব না। এর জন্য আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যুক্ত করতে হবে, বলেন রাকিবুল আমিন।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে পাখি হলো বৈশ্বিক বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি আমরা এই পাখি এবং তাদের অবাসস্থল রক্ষা করতে না পারি তবে এই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং করোনা কিংবা বার্ড ফ্লু আপনাআপনিই হানা দিবে। তাই মাঝে মাঝে আমাদের প্রকৃতিকে নিজের ইচ্ছায় কিছু সময় দিতে হবে যাতে সে নিজের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারে। মানবজাতির ঠিকে থাকার জন্যই আমাদের এই কাজ করতে হবে বলেন তিনি।
Comments