‘আব্বুকে এক পলক দেখতেও পারিনি’

সপরিবারে ডা. আবদুল্লাহ আল মারুফ রাসেল। ছবি: সংগৃহীত

মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল্লাহ আল মারুফ রাসেল। রোগীদের খুবই প্রিয় এই ডাক্তার চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হন করোনাভাইরাসে। সেই সঙ্গে তার স্ত্রী গাইনি বিশেষজ্ঞ মির্জা ফারজানা হলিও আক্রান্ত হন।

করোনা শনাক্ত হওয়ার পরই তারা চলে যান আইসোলেশনে। গত ৫ মে তাদের করোনা শনাক্ত হয়।

ডা. রাসেল পরিবার নিয়ে মৌলভীবাজারে বসবাস করছেন চাকরির সুবাদে। তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর গত ৭ মে ঢাকায় বসবাসরত তার বাবা মো. আব্দুর রহিম (৭০) অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ১১ মে মৃত্যুবরণ করেন। বাবার অসুস্থতা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো সময়ই পাশে থাকতে পারেননি ডা. আবদুল্লাহ আল মারুফ রাসেল। এমনকি অংশ নিতে পারেননি বাবার জানাজায়ও। এই আফসোস করোনা আক্রান্ত হওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাকে। এখনও মৌলভীবাজার পৌর শহরের একটি এলাকায় নিজ বাসায় আইসোলেশনে আছেন এই চিকিৎসক দম্পতি।

ডা. আবদুল্লাহ আল মারুফ রাসেল বলেন, ‘আমি এবং আমার স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছি তাতে আমার দুঃখ নেই। কারণ, চিকিৎসা সেবার যে মহান ব্রত নিয়ে এই পেশায় এসেছি তা চালিয়ে যাওয়া নৈতিক দায়িত্ব। দেশের এই সংকটের সময়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারি না। সরকারি হাসপাতালে প্রতিদিনের ডিউটি, প্রাইভেট চেম্বার সব জায়গায়তেই আমি রোগীদের সেবা দিয়েছি। প্রথমে চেম্বার বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করলেও রোগীদের বিরম্বনা এড়াতে চেম্বার চালু রাখি। এর মধ্যে গত ৫ মে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের অন্য কয়েকজন ডাক্তারের মতো আমিও সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হই।’

‘আক্রান্ত হওয়ার দুদিন পর আমার বাবা অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। সারাজীবন যে বাবা আমাকে তিলতিল করে গড়ে তুলেছেন সে বাবার অসুস্থতার মুহূর্তে পাশে থাকতে পারিনি। বাবার শেষ ইচ্ছা কী ছিল জানতে পারিনি। বাবার হাত ধরে বলতে পারিনি আব্বু আর কিছুটা দিন থাকো। ১১ মে বাবা মারা গেলেন। আমরা দুই ভাই ও দুই বোন। সবাই বাবার পাশে থাকতে পারলেও আমি বাবার শেষ বিদায়ে পাশে থাকতে পারিনি, জানাজা পড়তে পারিনি। আব্বুকে এক পলক দেখতেও পারিনি।’

‘একদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় নিজের এবং স্ত্রীর জীবন নিয়ে চিন্তা, তার উপর আমাদের দুটো ছোট বাচ্চা আছে তাদের রেখে আলাদা থাকা। তাদের সুস্থতা নিয়ে চিন্তা করা, সেই সঙ্গে বাবার চলে যাওয়া। সব মিলিয়ে এই সপ্তাহটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। এমন খারাপ সময় জীবনে কখনও আসেনি।’

‘একজন করোনায় আক্রান্ত রোগীর মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে এটা শুধু সেই বুঝবে যে আক্রান্ত হয়েছে। তার ওপর আমার স্ত্রী আক্রান্ত মানে স্বামী হিসেবেও টেনশনে আছি। বাবাকে হারিয়েছি, তাই সন্তান হিসেবে সবচেয়ে বড় কষ্টটা ছিল। নিজের জীবন নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে এমনকি বাবাকে হারিয়ে তিনদিক ধরে যে ঝড় আমার জীবনে এসেছে তার মধ্যে আরেকটি হচ্ছে আমি নিজেও বাবা।’

‘যখন আমরা আক্রান্ত হলাম আমাদের সন্তান আক্রান্ত হয়েছে কিনা বা তারা নিরাপদ আছে কিনা সেটাও ভাবতে হয়েছে। জীবনের এই কঠিন মুহূর্তে ৫ মে থেকে আজ পর্যন্ত আমি আমার সন্তানকে একবারের জন্যও কোলে নিতে পারিনি। একজন বাবা হিসেবে এটা খুব কষ্টের। কোনো কিছু বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না। শুধু এটা চাই আল্লাহ যেন আমার পরিবারের সবাইকে ভালো রাখেন। সবাই আমার আব্বুর জন্য দোয়া করবেন।’

আবেগপ্রবণ হয়ে ডা. মারুফ বলেন, ‘আব্বু অসুস্থ থাকায় আব্বুকে জানাতে পারিনি আমি নিজেও করোনায় আক্রান্ত। আব্বু জেনে গেলেন না, কেন তার সন্তান মৃত্যুর সময় তার পাশে ছিল না, কেন অসুস্থ জেনেও ছেলে দেখতে আসলো না। এমন কঠিন মুহূর্ত অন্য কারো জীবনে না আসুক সেটাই আমি চাই।’

‘বিপদের এই সময়ে যারা বিভিন্নভাবে আমাকে সাহস দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে মৌলভীবাজার বিএমএর সভাপতি ডা. সাব্বির খান এবং সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাজান কবির চৌধুরী যেভাবে আমার এবং আমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাতে আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’

উল্লেখ্য, মৌলভীবাজারের জনপ্রিয় এই ডাক্তার করোনা সংকটের শুরু থেকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। কখনো বন্ধ করেননি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া। বর্তমানে নিজে অসুস্থ এবং মানসিকচাপে থাকলেও প্রতি মুহূর্তে ফোনে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। নিজে ভালো না থাকলেও রোগীদের সময় দিয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে প্রশংসিত হয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছেও।

মৌলভীবাজার চেম্বারের সাবেক সভাপতি ডা. এমএ আহাদ বলেন, ‘আমার সঙ্গে কার অনেক দিনের পরিচয়। একজন চিকিৎসক হিসেবে ডা. মারুফ রোগীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। নিজে সবদিক থেকে মানসিক চাপে থাকলেও রোগীদের পাশে আছেন এখনো। এমনকি করোনা সংকট শুরুর পর যখন অনেকেই ঘরে চলে গিয়েছিলেন, ডা. মারুফ তখন সবদিকেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন সমান তালে। আমি তার সুস্থতা কামনা করছি।’

মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদ আহমদ বলেন, ‘ডা. মারুফ চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আমরা সবাই জানি করোনার সঙ্গে যে যুদ্ধ, তার সামনের সারির সৈনিক চিকিৎসকরা। সব কিছু মিলিয়ে তিনি কঠিন মুহূর্ত কাটাচ্ছেন। মানসিকভাবে তিনি খুব শক্ত মানুষ। তবুও বাবা হারানোর বেদনার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। আল্লাহ যেন তাকে এই অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্ত করেন।’

Comments

The Daily Star  | English

All customs houses open this weekend to clear backlog

All customs houses across the country will remain open for import and export activities this weekend – today and tomorrow..The customs policy wing of the National Board of Revenue (NBR) yesterday issued directives to the customs houses in Chattogram, Dhaka, Benapole, Mongla, Customs House

32m ago