জাপানের করোনা মোকাবিলার সফল মডেল ‘টিটিটি’

গত ১৪ মে জাপানের ৪৭টি অঞ্চলের (জেলা) মধ্যে ৩৯টি থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকি আটটির জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারলে এই শহরগুলোও জরুরি অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। যে বেগে করোনা উধাও হচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২১ মে’র মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধাপে ধাপে শুরু করতে পারবে জাপান।
টোকিওর একটি ভবনের স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। ১৪ মে ২০২০। ছবি: রয়টার্স

গত ১৪ মে জাপানের ৪৭টি অঞ্চলের (জেলা) মধ্যে ৩৯টি থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাকি আটটির জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারলে এই শহরগুলোও জরুরি অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। যে বেগে করোনা উধাও হচ্ছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২১ মে’র মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ধাপে ধাপে শুরু করতে পারবে জাপান।

করোনা মোকাবিলায় জাপানের পারফরম্যান্স কেমন ছিল?

ম্যানেজমেন্টে কিছু দুর্বলতা ছিল। তবে, শেষ ভালো যার, সব ভালো তার— এই সূত্রে দুর্বলতাগুলো মানুষ ভুলতে শুরু করেছে। করোনা মোকাবিলায় জাপানি মডেল কাজ করেছে।

একটি দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি তিনটি ক্যাটাগরি দিয়ে বোঝানো হয়ে থাকে—

১. আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে শূন্যের দিকে এগোচ্ছে— বিজয়ী গ্রুপ।

এই গ্রুপে আছে— অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, ভুটান, চীন, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, তিউনিসিয়া ও ভিয়েতনামসহ ৪১টি দেশ।

২. আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির পর এখন কমের দিকে— আয়ত্তে আছে গ্রুপ।

এই গ্রুপে আছে— বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইসরায়েল, ইতালি, জাপান, মালয়েশিয়া, হল্যান্ড, স্পেন ও শ্রীলঙ্কাসহ ২৭টি দেশ।

৩. আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে— অ্যাকশন দরকার গ্রুপ।

এই গ্রুপে আছে— আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ফিনল্যান্ড, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ব্রিটেন ও আমেরিকাসহ ৩৪টি দেশ।

পুরো তালিকাটি এখানে আছে (তিন ক্যাটাগরিতে বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি)। প্রতিদিনই লিস্ট পরিবর্তন হচ্ছে। জাপান শিগগিরই প্রথম গ্রুপে যাবে।

জাপান কি লকডাউন দিয়েছিল?

না, দেয়নি। জাপানের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সরকারের সেই ক্ষমতা নেই। সরকার জনগণকে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো আদেশ দিতে পারে না। কেবলমাত্র অনুরোধ করতে পারে। তাই দিয়েছিলেন জরুরি অবস্থা ঘোষণা। কীভাবে চলাফেরা করতে হবে, তার জন্য দিয়েছিলেন গাইডলাইন। তাই কোনো পুলিশ নামাতে হয়নি। কোনো লাঠির আওয়াজও পাওয়া যায়নি।

গাইডলাইন সবার জানা। বিশ্বজনীন। তবে, গাইডলাইন পালন করার জন্য জাপানে কিছু অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান ছিল।

ক. সামাজিক দূরত্ব: জাপানিরা সাধারণত বিদেশিদের মতো কোলাকুলি বা হ্যান্ডশেক করে না। দূর থেকে বাউ করে। কিছুটা দূরত্ব আগে থেকেই বজায় ছিল।

খ. হাত ধোয়া: জাপানের যে কোনো রেস্টুরেন্টে যান, আপনাকে প্রথমেই একটা ভেজা টাওয়েল দেবে, হাত মোছার জন্য। এটা বাধ্যতামূলক। কিছু কিছু শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা থাকে। তা ছাড়া, টয়লেটের বেসিনগুলোর ট্যাপ অধিকাংশই স্পর্শহীন সেন্সরে চলে। সুতরাং, সংক্রমণের সম্ভাবনা কম ছিল।

গ. মাস্ক পরা: শীতকালে জাপানে ইনফ্লুয়েঞ্জার উপস্থিতি, পোলেন (পরাগরেণু) অ্যালার্জিজনিত কারণে এমনিতেই ছোটবাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ প্রায় সবাই মাস্ক পরে।

তারপরও করোনা জাপানে ঠিকই হিট করেছে। অনেকেই প্রশ্ন করছেন—

ঘ. জাপানে করোনা টেস্ট কীভাবে করে?

ঙ. সংক্রমণ বন্ধ করছে কীভাবে?

চ. জাপানি ওষুধ নাকি করোনার জন্যে কার্যকর, এ কথা সত্য?

ছ. জাপানে যথেষ্ট আইসিইউ, মেডিকেল ইকুইপম্যান্টের ঘাটতি আছে?

প্রথমে কিছু সাধারণ তথ্য।

জাপানের প্রত্যেক নাগরিককে বছরে একবার হেলথ চেকআপ করতে হয়। যা বাধ্যতামূলক। এই কাজটি করা হয় স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, হেলথ ক্লিনিকে। বুঝতে পারছেন, কত বড়ো ইনফ্রাস্ট্রাকচার আগে থেকেই তৈরি আছে। মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তার সবই পর্যাপ্ত। তা ছাড়া, সার্স ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক রোগের জন্যও প্রস্তুতি আছে, অভিজ্ঞতা আছে।

সব নাগরিক হেলথ ইনস্যুরেন্সের অন্তর্ভুক্ত। পপুলেশন ম্যানেজমেন্টে পৃথিবীর সেরাদের দলে তারা। কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। পপুলেশন ম্যানেজমেন্টের বড় সুবিধা হলো— কার কী কী পরীক্ষা করা দরকার, কখন করা দরকার, কতবার করা দরকার, এ সবকিছুই আগে থেকে তৈরি আছে।

১. করোনা টেস্ট কীভাবে করে?

জাপানে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ১৬ জানুয়ারি। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই তৈরি হয় করোনা প্রতিরোধে ১২ সদস্যের একটি প্যানেল। সেই প্যানেলে সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ, গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, মানসিক বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী ও সমাজ বিজ্ঞানী আছেন। তৈরি হয় ন্যাশনাল স্ট্রাটেজি— টিটিটি (টেস্ট, ট্রেস, ট্রিট) মডেল। স্থির করা হয় পিসিআর টেস্টের জন্য ট্রিয়াজ। কোন উপসর্গ কতটুকু থাকলে কী চিকিৎসা দেওয়া হবে, তার সহজ একটা ফরমুলা। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমলে ফরমুলাকে শিথিল করা হয়। টেস্টের সংখ্যাও কমে যায়।

কেবলমাত্র যাদের উপসর্গ আছে ও ইন্টারনাল মেডিসিনের রিকমেন্ডেশন আছে অথবা যারা কোনো করোনা রোগীর ক্লোজ কন্টাক্টে ছিলেন, তারাই পিসিআর টেস্ট করার জন্য যোগ্য।

কেউ বলছেন, সবার টেস্ট কেন করা হচ্ছে না? কেউ উত্তর দিচ্ছেন, কী দরকার গণহারে টেস্ট করার? হয়তো কোরিয়ার মতো ১-২ শতাংশ লোক শনাক্ত হবে। সে ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ টাকা নষ্ট।

তা ছাড়া, একবার টেস্ট করলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে, তাতো না। টেস্টের পরেও তো আক্রান্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজনকে বারবার টেস্ট করাতে হবে। কেউ বলছেন, গণহারে টেস্ট করলে আসল তথ্য বেরিয়ে পড়বে, তখন সবাইকে সামলাতে পারবেনা। কিছু বিভ্রান্তি, সরকারের ওপর অবিশ্বাস এদেশেও আছে।

আমাদের ফুকুওকা শহরে প্রথম যিনি করোনা আক্রান্ত হন, তার হিস্ট্রি থেকে জানা গেল, তিনি কখনো বিদেশে যাননি। এমনকি এরমধ্যে টোকিওতেও যাননি। চিন্তার বিষয়। তার করোনা এলো কোথা থেকে? নিশ্চয়ই আরও আক্রান্ত আছে অথবা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ জানালেন, একজন শনাক্ত হওয়া মানে হলো— সে ইতোমধ্যে আরও ৫০ জনকে সংক্রমিত করতে করতে হাসপাতালে এসেছে। তাই টেস্ট সংখ্যা বাড়ানো উচিত। তবে, উপসর্গ দেখা গেলে তারপর টেস্ট।

গ্র্যান্ড প্রিন্সেস নামক একটা ক্রুজশিপে ৩ হাজার ৭১১ জন যাত্রী ছিলেন। তাদের ২০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৯৬ জন যাত্রীই করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। সবাইকে জাহাজে রেখেই সেবা দেওয়া হয়েছে। একটা ক্লাস্টার জাহাজেই তৈরি হলো। সেবা-শুশ্রূষার জন্য ২ হাজার ৭০০ জন সেলফ ডিফেন্স ফোর্স নিয়োগ করা হয়েছিল। তাদের কেউই আক্রান্ত হননি। রোগী থেকে ডাক্তারদের সংক্রমণ ছিল শূন্য শতাংশ।

২. সংক্রমণ রোধে জাপান কী করছে?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একজনের করোনা শনাক্ত হলো ১৭ মার্চ। কোনোরকম গুজব ছড়ানোর আগে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রেস রিলিজ দিলেন। প্রেস রিলিজের ভাষা খুব সহজ। রোগীর ব্যক্তিগত কোনো তথ্য যেন প্রকাশ না পায়, তার ওপর আলাদা গুরুত্ব দিলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন একজন মুখপাত্র। জ্বী, একজন। যাতে সংবাদে কোনো ধরনের ভুল অথবা অসামঞ্জস্য না থাকে।

আক্রান্ত ব্যক্তি একজন বিদেশি ছাত্রী। নাম বলা নেই। দেশের নাম বলা নেই। মেয়েটি একটি স্টাডি ট্যুরে ইউরোপে গিয়েছিলেন। সঙ্গে দুই জন শিক্ষক ও তিন জন সহপাঠী ছিলেন। প্রেস রিলিজে উল্লেখ করা হলো— আক্রান্ত ব্যক্তির বয়স ৩০’র ঘরে, বিদেশি, ছাত্রী। ৩ মার্চ ইউরোপে স্টাডি ট্যুরে গিয়ে ৯ মার্চ ফুকুওকাতে ফিরে আসে। ১০ মার্চ জ্বর-জ্বর ভাব। ১৬ মার্চ পিসিআর টেস্ট। ১৭ মার্চ ফলাফলে করোনা পজিটিভ।

টেস্টের পর শুরু হল ট্রেস। সহযাত্রী সবার সঙ্গে যোযাযোগ করা হলো। একজন দেশের বাইরে। বাকি সবাইকে বাসা থেকে বের না হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনা সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সদর দপ্তর (এখানে লক্ষ্য করুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অলরেডি নির্বাচন কমিশনের মতো সদর দফতর তৈরি করা হয়েছে) ফুকুওকা সিটি অফিসের সঙ্গে কাজ করবে। এই রোগ যেন আর সংক্রমিত না হতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

মেয়েটি যে প্রোগ্রামে ইউরোপে গিয়েছিল, সেই প্রোগ্রামের ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে আমি কিছুটা জড়িত। ১৭ মার্চ রাত দেড়টা পর্যন্ত মেইল চালাচালি হলো। ১৮ মার্চ সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে পরবর্তী স্টেপগুলো নির্ধারিত হলো। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্তৃপক্ষকে পরবর্তী স্টেপগুলো নিয়ে নির্দেশনামা পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এই হলো ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে জাপানি কাজের স্পিড।

কীভাবে এই স্পিড আর নিখুঁত সিদ্ধান্ত সম্ভব?

সোজা। ‘ভূমিকম্প’ আসলে কী করতে হবে, মহামারি আসলে কী করতে হবে— এসব গাইডলাইন আগেই তৈরি করা আছে। কনসেপ্ট টেস্টিং অ্যান্ড প্রুফ করা। ‘আগে আসুক তারপর দেখা যাবে’— এমন রীতি ৭০ বছর আগেই জাপান বিদায় করেছে।

সংক্রামক ব্যাধি তো এটা প্রথম নয়। করোনাও প্রথম নয়। সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম), মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) সবই তো করোনা। তবে, এবারের নভেল করোনার স্পিড আলাদা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিভাগ আছে, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট। তাদের ওয়েবসাইটে করোনা নিয়ে শিক্ষার্থী ও স্টাফদের নির্দেশাবলী দেওয়া আছে। ‘কী ঘটলে কী করতে হবে’— তা সুন্দর ডায়াগ্রাম দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো উপসর্গ দেখা দিলে একটি হটলাইনে ফোন করতে হবে। হটলাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা। ১৮টি ভাষায় কথা বলা যাবে। কারণ, এখানে বিদেশিরাও থাকেন, যারা জাপানি বলতে পারেন না। তাদের জন্য এই ব্যবস্থা। এটা ফুকুওকা সিটি অফিস মেইন্টেইন করে। জাপানের ৪৭টি জেলার মোটামুটি সব জেলাতেই হটলাইনের ব্যবস্থা করা।

রোগীর সহযাত্রীদের নিয়ে পিসিআর টেস্ট করতে গেলাম। জাপানে সবাই পিসিআর টেস্ট করার জন্য যোগ্য নন। রোগীর সহযাত্রী টেস্টের যোগ্য। তার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম ১৮ মার্চ বিকালে।

হাসপাতালে গেলাম গাড়ি নিয়ে। আমাদের গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলা হলো। দুই জন নার্স এলেন। ফকফকে সাদা পোশাক পরা। আমি ভেবেছিলাম হয়তো মহাকাশযাত্রীদের মতো ড্রেস পরে আসবেন। একেবারেই স্বাভাবিক ড্রেস। শুধু মুখমণ্ডল একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। অনেকটা বিয়ের পাগড়ি যে ধরনের বাক্সের মধ্যে থাকে, তার শুধু প্লাস্টিক অংশটার মতো। আমার মনে হয় রোগী যেন আতঙ্কিত না হয়, এর জন্য তারা সাধারণ, কিন্তু সুরক্ষিত পোশাক ব্যবহার করছেন।

ভেতরে গেলাম। সাধারণ একটি রুম। রুমে ঢোকার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে দিলেন।

একটা লম্বা কটনবাডের মতো নল নাকে ঢুকিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলেন। তিন মিনিটের কাজ। পরদিন বেলা ২টায় ফলাফল এলো। সহযাত্রী সবাই নেগেটিভ। তবে, দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।

১৭ মার্চ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর, সব সহযাত্রীদের দুই ধরনের ফরম ধরিয়ে দিলেন। ৯ মার্চের পর কোথায় কোথায় গিয়েছিল, কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তার কন্টাক্ট লিস্ট। জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথাব্যথাজনিত উপসর্গের তথ্য।

সহযাত্রীদের একজনের কন্টাক্ট লিস্টে আমার নাম আছে। আমিও ২৩ মার্চ পর্যন্ত গৃহবন্দি।

১৭ জানুয়ারি প্রথম করোনা শনাক্তের পর যেভাবে দায়িত্ব ভাগাভাগি হলো— সেটা বলি।

জাপানে কোনো ধরনের ইনসিডেন্ট হলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের তিন ধরনের তথ্য দিতে হয়। এক. জিজিতসু কাকুনিন— ঘটনা কীভাবে ঘটলো তার বর্ণনা, দুই. কোনগো নো তাইসাকু— এই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তাতে তোমার কী করণীয়, তিন. বোউগাই হোহো— কীভাবে ঠেকানো যেত।

এ প্রোগ্রামে জড়িত শিক্ষকরা নিজ অবস্থান থেকে ঘটনার বর্ণনা দিলেন, ঠেকানোর উপায়ের বর্ণনা দিলেন। দোষ নিজের ওপর নিলেন, শিক্ষার্থীর ওপর চাপালেন না। সরকারের ওপরেও না।

৩. জাপানি ওষুধ নাকি করোনার জন্যে কার্যকর, এ কথা সত্য?

জাপানের তৈরি একটি অ্যান্টি-ফ্লু ড্রাগ অ্যাভিগান চীনের করোনা রোগীদের ওপর প্রয়োগ করে ফল পাওয়ার দাবি করছে চীন। কিন্তু, জাপানি কোম্পানি এ নিয়ে কোনো বাহাদুরি বিবৃতি দেয়নি। জাপান সরকার নিজেদের মতো করে ওষুধ টেস্ট করেছেন। সন্তোষজনক ফলাফল পেয়ে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন।

৪. জাপানে যথেষ্ট আইসিইউ, মেডিকেল ইকুইপম্যান্টের ঘাটতি আছে?

আগেই বলেছি, জাপানে বছরে ১২ কোটি মানুষের হেলথ চেকআপ করার লজিস্টিকস প্রস্তুত আছে। তবে, করোনার ক্ষেত্রে পিসিআর টেস্ট কিট, আইসোলেটেড আইসিইউ, পিপিই জাতীয় বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়।

জাপানে করোনা রোগী শনাক্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে। এটি বাধ্যতামূলক। চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বের হওয়ার নিয়ম নেই। জাপানে শুধু করোনার জন্য ডেডিকেটেড বেডের সংখ্যা ৩১ হাজার ২৮৯টি। ৪৭টি জেলার মধ্যে শুধু তিনটি জেলা (ইওয়াতে, ওয়াকায়ামা আর নাগাসাকি) ছাড়া সবগুলো জেলাতে করোনার জন্য ডেডিকেটেড বেড ক্যাপাসিটি (আইসিইউ বলতে পারেন) ৭ হাজার ৯৩৪টি। সবচেয়ে বেশি আছে টোকিওতে (২ হাজার ৮৬৫টি)। আর সবচেয়ে কম আছে আকিতা আর কোচি জেলায় (১৬টি)। তা ছাড়া, আটটি স্পেশাল জায়গায় তৈরি হয়েছে ১০ হাজার ৩২০টি। (মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটি তথ্য, জাপানিজ ভাষায়)

গতকাল ১৫ মে ব্যবহার হচ্ছে কয়টি জানেন? মাত্র ৫৬৭টি। পিক অবস্থাতেও ৩০ শতাংশ ব্যবহৃত হয়নি।

অনেক জাপানিজ পিসিআর টেস্ট করাতে না পেরে মন খারাপ করেছেন। অনেকের যথেষ্ট উপসর্গ থাকার পরও টেস্ট করাতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন। টোকিওতে এক রোগী অ্যাম্বুলেন্সে করে এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল ঘুরেছেন। সার্ভিস পাননি, ভালো ব্যবহার পাননি— এমন অভিযোগও আছে। জাপানের চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বল অংশগুলো বেরিয়ে এসেছে। নিশ্চয়ই টাস্কলিস্টে এই অভিযোগগুলো যুক্ত হয়ে গেছে।

বিবিসিসহ কিছু মিডিয়া এগুলোর ভুল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা দিয়েছে। ‘জাপানের মেডিকেল সিস্টেম কলাপস করেছে’— এমন সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। যা একেবারেই অসত্য।

বর্তমানে কী অবস্থা? (জাপানের পরিস্থিতি)

প্রথমেই বলেছি, গত ১৪ মে জাপানের ৪৭টি অঞ্চলের (জেলা) মধ্যে ৩৯টি থেকে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়েছে। জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার জন্য তৈরি করেছেন একটা মডেল। প্রত্যেক আইনেই একটা এক্সিট ক্লজ থাকে। আইন প্রয়োগ করার জন্য শর্ত যেমন থাকে, আইন তুলে নেওয়ার জন্যও থাকে কিছু শর্ত।

সরকার সেই শর্ত প্রস্তুতের জন্য বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগিয়েছেন। যাতে শর্তগুলো ন্যায্য ও নিরপেক্ষ হয়। তৈরি করেছেন সার্বজনীন একটা মডেল। ওসাকায় তৈরি হয়েছে বলে এটার নাম দিয়েছেন ‘ওসাকা মডেল’।

শর্তগুলো বুঝতে কষ্ট না হলেও, এই শর্তে পৌঁছাতে কত ঘাম বাষ্প হয়েছে তা কল্পনা করতে পারি।

আনলিংকড নতুন আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে ১০ জনের কম, পিসিআর টেস্টে পজিটিভ হার গড়ে সাত শতাংশের কম ও আইসিইউ ব্যবহার ক্যাপাসিটির ৬০ শতাংশের কম হতে হবে। এমন অবস্থা টানা সাত দিন চলতে থাকলে সেই শহরের জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া যাবে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ধাপে ধাপে শুরু করতে পারবে।

এই মডেল বাংলাদেশে কাজে লাগবে না। তবে, বাংলাদেশের আদলে তৈরি হতে পারে— বাংলাদেশ করোনা লকডাউন মডেল, বাংলাদেশ ট্রিয়াজ, বাংলাদেশ করোনা এক্সিট মডেল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, ট্রিয়াজ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছি। একটা ড্রাফট ট্রিয়াজ তৈরিও হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগ্রহী হলে সহযোগিতা করতে পারি।

লেখক: ড. আশির আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান। গবেষণা করছেন বিশ্বের তৃণমূল জনগণের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি উন্নয়ন নিয়ে।

[email protected]

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Over 5,500 held in one week

At least 738 more people were arrested in the capital and several other districts in 36 hours till 6:00pm yesterday in connection with the recent violence across the country.

13h ago