পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত, বোরোর বাম্পার ফলন

আগামী ছয় মাস খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই

সারা দেশে চলমান বোরো ধান কৃষকের ঘরে উঠলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা নেই।
Rice-1.jpg
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

সারা দেশে চলমান বোরো ধান কৃষকের ঘরে উঠলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে খাদ্য ঘাটতির সম্ভাবনা নেই।

খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বোরোর বর্তমান ও আসন্ন মজুদ শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমন ধান প্রস্তুত হয়ে যাবে।

তবে তারা যোগ করেছেন, আগামী দিনে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে মাছ, গবাদি পশু ও শাকসবজিসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করা। শাকসবজি ও মাছ চাষিরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে না পারার কারণে ইতিমধ্যে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন।

আমনের ফলন বৃদ্ধি, উচ্চফলনশীল গম ও সরকারি গোডাউনগুলোতে মোটামুটি ভালো পরিমাণে খাদ্যশস্য মজুত থাকার পাশাপাশি বোরোর ভালো ফলন সম্ভাবনার আশ্বাস দেয়। এর থেকে আশা করা যায় কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে খাদ্য পর্যাপ্ততার দিক থেকে দেশ ভালো অবস্থানে থাকবে।

তবে, উদ্বেগের বিষয় দাম। যেসব অঞ্চলে বোরো উত্পাদন হচ্ছে সেখানে দাম বাড়ার কারণে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

খাদ্য মন্ত্রী সাধন কুমার মজুমদার বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকায় খাদ্য নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। বোরো সংগ্রহ শুরুর আগেও আমাদের ১২ লাখ ৭৫ হাজার টন চালের মজুদ ছিল। এখন বোরো ও গম সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সুতরাং কয়েক মাসের জন্য কোনো প্রকার উদ্বেগ নেই।’

সরকারি এই মজুত শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষদের সহায়তার জন্য সরকার ব্যবহার করে। তবে ফসলের মূল অংশ থেকে যায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের হাতে। এবং চলতি বছর বোরো উত্পাদন ভালো হয়েছে বলে তিনি জানান।

সরকারি খাদ্য মজুত

১১ মে পর্যন্ত সরকারি গোডাউনগুলোতে চালের মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৭ হাজার টন এবং গমের মজুত ছিল ২ লাখ ৮২ হাজার টন। খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে সরকারি গুদামগুলোতে বর্তমান খাদ্য মজুদ ‘সন্তোষজনক’।

সরকার ২৬ এপ্রিল থেকে ধান ও গম সংগ্রহ শুরু করেছে মোট ৮ লাখ টন ধান ও ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে।

খাদ্য বিভাগ ১১ মে পর্যন্ত ১০৪ টন ধান এবং ৮২৬ টন চাল কিনেছে। এ ছাড়াও তারা এ বছরের ফসল থেকে ১৫ হাজার ২৮০ টন গম সংগ্রহ করে ফেলেছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৫ হাজার টন।

সরকারের গুদামগুলোতে ১৯ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করার সক্ষমতা রয়েছে। খাদ্য মজুদ ছাড়াও বাজারে ধানের বেশ ভালো সরবরাহ রয়েছে।

বোরো চাল

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকরা ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছেন।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির বলেন, ‘ফসল কাটার তথ্যের ভিত্তিতে, এটা বলা যেতে পারে যে আমরা এই বোরো মৌসুমে ২ কোটি চার লাখ টন বোরো উত্পাদন লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব। যেহেতু আমরা ভালো ফলন পেতে চলেছি তাই আগামী সাত থেকে আট মাস ধানের মজুদ থাকবে। কোনো সমস্যা হবে না।’

দেশে বার্ষিক উৎপাদিত ধানের অর্ধেকেরও বেশি অংশ বোরো।

গত মাসে বাংলাদেশ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদনে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) অনুকূল আবহাওয়া ও কম কীটপতঙ্গের আক্রমণ হওয়াকে সাধুবাদ জানিয়ে জানিয়ে চলতি মৌসুমে বোরো উত্পাদন বেশি হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে।

এ ছাড়া শাহজাহান জানান, আসন্ন ধানের মৌসুমের জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় প্রণোদনা দিয়েছে।

মন্ত্রণালয় গত মাসে আউশ মৌসুমে কৃষকদের উত্সাহিত করতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বীজ ও সার সরবরাহের জন্য ৯ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মালিকানাধীন পাম্পগুলোর জন্য সরকার সেচের চার্জ অর্ধেক কমিয়েছে।

আগাম মৌসুমে আউশ চাষের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১৩ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর করা হয়েছে। যা আগের মৌসুমের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। আউশ উত্পাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ লাখ টন, যা আগের বছর ছিল ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টন।

বিআরআরআই-এর মহাপরিচালক বলেন, ‘আমন নিয়ে আমরাও ভালো পরিকল্পনা করে এগিয়ে যাচ্ছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে সবকিছুই ভালো হবে।’

বছরের এপ্রিল-মে মাসে বোরো ফসল কাটা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট উৎপাদিত ৩ কোটি ৬৪ লাখ টন চালের মধ্যে বোরো ছিল প্রায় ৫৪ শতাংশ।

এর পাশাপাশি বৃষ্টি নির্ভর আমন ধান মৌসুমে ৩৮ শতাংশ এবং আউশ ধান মৌসুমের বাকী আট শতাংশ উৎপাদন পূরণ করে।

শাহজাহান কবির জানান, বাংলাদেশের বার্ষিক চাহিদা সাড়ে ৩ কোটি টন।  এবং প্রাক্কলন করা চাহিদার তুলনায় গত বছরের মোট উত্পাদন বেশি হয়েছে। সম্ভাব্য উৎপাদন দেখাচ্ছে যে গত বছরের উৎপাদন চাহিদার থেকে বেশি ছিল। এবং উত্পাদন বৃদ্ধির ফলে দেশকে আমদানিকৃত চালের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে সহায়তা করেছে।

চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ের প্রথম থেকে মে মাসের মধ্যে ধানের আমদানি ৯৮ শতাংশ কমে চার হাজার ১৮০ টন হয়েছে। যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ ৫ হাজার ৭৯০ টন।

বিআরআরআই-এর মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা ধান উৎপাদনে স্বাবলম্বী। আমরা প্রতি তিন মাসে উত্পাদন ও ধান কাটার তথ্য রেকর্ড করি। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষের সুযোগ নেই। মূল কাজটি হচ্ছে সবার কাছে এগুলো পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি রোধে বাজার পর্যবেক্ষণও করা উচিত।’

ইউএসডিএর তথ্য অনুসারে, ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চাল উত্পাদন করে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। যথাক্রমে চীন ও ভারত আছে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে। চীনের বার্ষিক উৎপাদন ১৪ কোটি ৬০ লাখ টন এবং ভারতের ১১ কোটি ৬০ লাখ টন। এর আগে ইন্দোনেশিয়া ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন চাল উত্পাদন করে তৃতীয় অবস্থানে ছিল।

কৃষি অর্থনীতিবিদ এম এ সাত্তার মণ্ডল জানান, ফসল কাটার বাকি সময়গুলোতে প্রতিকূল আবহাওয়া না থাকলে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চাল নিরাপদেই কৃষকের ঘরে উঠবে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাত্তার মণ্ডল বলেন, ‘মনে হচ্ছে এবার ভালো ফলন হবে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দিন জানান, ধান চাষিরা সাধারণত বোরোর মোট উৎপাদনের ৫০-৭০ শতাংশ বাজারজাত করেন। তাই, উত্পাদন পূর্বাভাস থেকে ধারণা করা যায় বাজারজাত যোগ্য শস্য থাকবে ১ কোটি থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ টন।

সাত্তার মণ্ডল আরও জানান, বোরোর পরে এখন সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হওয়া বৃষ্টি নির্ভর আমন ধানের দিকে যতটা সম্ভব নজর দেওয়া উচিত। এর পরিমাণ মোট বার্ষিক ধান উৎপাদনের ৩৮ শতাংশ।

কতটা খাদ্য প্রয়োজন

আমাদের প্রতিবছর কতটা খাদ্য প্রয়োজন? এ প্রশ্নের জবাবে কৃষি গবেষক ও আইএফপিআরআইয়ের বাংলাদেশের প্রতিনিধি আক্তার আহমেদ ইউএসডিএর গবেষণার বরাত দিয়ে জানান, মে ২০১৯ থেকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩ কোটি ৫৮ লাখ টন খাদ্যশস্য (চাল ও গম) সরবরাহ হয়েছে। ইউএসডিএ মাসিক পরিসংখ্যান অনুসারে, বাংলাদেশে গত এক বছরে মোট ৩ কোটি ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য ভোগ করা হয়েছে।

শাকসবজি এবং প্রোটিনের উত্স

খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান জানান, একবার বোরো ফসল উঠলে দেশ কমপক্ষে আগামী ছয় মাস কোনো খাদ্য সংকটের মুখে পরবে না।

তাই, সরকারের এখন শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ ঠিক করার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত বলে তিনি যোগ করেন।

তিনি বলেন, ‘কৃষকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের উৎপাদিত সবজি পাঠাতে পারছেন না। সরকারের উচিত তা অবিলম্বে এই বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া।’

Comments

The Daily Star  | English
Islami Bank's former managing director Abdul Mannan

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago