সাড়ে চার মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৫১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা

বগুড়ার ছেলে বজলুর রশিদ বছর দুয়েক আগে ধার-দেনা করে কৃষি শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যান। এখন তিনি গড়ে প্রতিমাসে ১৫-২০ হাজার টাকা দেশে পাঠান। করোনায় সৌদি আরবে লকডাউনসহ নানা সমস্যায় মার্চে টাকা পাঠাতে না পারলেও এপ্রিলে তিনি ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন বলে জানালেন তার স্ত্রী মাহাবুবা বেগম। মূলত এই টাকাতেই এখন তাদের সংসার চলে।
মাদারীপুরের ছেলে শাহাদাত হোসেন থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে। সেখানে তার একটি ছোট্ট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আছে। যেখানে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কাজ করেন। তিনি জানালেন, দেশের সংকটের কথা ভেবে পরিবার ও স্বজনদের জন্য মার্চ মাসে ১৪ লাখ এবং এপ্রিল মাসে ৯ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন দেশে। তবে এই টাকা আগের। এখন কাজ নেই। সামনে কতো টাকা পাঠাতে পারবেন জানেন না। তবে সামনে যেহেতু ঈদ, চেষ্টা করবেন দেশে টাকা পাঠাতে। তিনি জানালেন, দুবাইতে এখন যতো বাঙালি আছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের এখন কাজ নেই। সামনে কী হবে তাও অনিশ্চিত।
বজলুর বা শাহাদাতের মতো ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি এখন বিদেশে কাজ করছেন। যার মধ্যে ৭৫ শতাংশেই আছেন মধ্যপ্রাচ্যে। গতবছর এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৮৩০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন। কিন্তু করোনার এই সংকটকালীন সময়ে তারাও নানা সংকটে আছেন। অনেকের বেতন কমে গেছে। অনেকের কাজ নেই। অনেক দেশে লকডাউন। রেমিট্যান্স হাউস বন্ধ। অনেককে দেশে ফিরতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। তবে এরপরেও প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেননি। বরং ধারদেনা করে হলেও এখনো চেষ্টা করছেন টাকা পাঠাতে। আর সামনে ঈদের কারণে মে মাসে প্রবাসী আয় বাড়তির দিকে। সবমিলিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১২ মে পর্যন্ত মোট ৬০৬ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন বাংলাদেশি টাকায়, যা ৫১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। মে মাসে যেহেতু ঈদ, এই মাসে প্রবাসী আয় বাড়ার ধারায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরে (জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) প্রবাসীরা ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। তবে ডিসেম্বরে করোনা শুরুর পর জানুয়ারি মাস থেকেই প্রবাসী আয় কমতে শুরু করে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৬৩ কোটি ডলার ও ফেব্রুয়ারিতে ১৪৫ কোটি ডলার এসেছে।
তবে করোনার কারণে ব্যাপকভাবে লকডাউন শুরু হওয়ায় মার্চে এসেছে ১২৮ কোটি ডলার। যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ১২ শতাংশ কম। আর এপ্রিলে প্রবাসীরা ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন।
তবে সামনে যেহেতু ঈদ, তাই মে মাসে প্রবাসী আয়ের ধারা বেড়েছে। মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই ৬২ কোটি ৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে। সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালের মার্চে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৩৩ মিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। এ বছরের মার্চে সেটা বেড়ে হয়েছে ১৫৬ মিলিয়ন ডলার। তবে গতবছরের এপ্রিলের চেয়ে এবার প্রবাসী আয় অনেক কমেছে। গতবছরের এপ্রিলে যেখানে ১৪১ মিলিয়ন ডলার এসেছে এবার সেখানে এসেছে মাত্র ৯০ মিলিয়ন ডলার।
মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই করোনার কারণে এই সংকট। কারণ বিদেশে অনেক রেমিট্যান্স হাউজ বন্ধ। প্রবাসীদের টাকা পাঠানো সহজ করতে আমরা একটি অ্যাপ চালু করেছি। যার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর প্রবাসীরা সহজেই টাকা পাঠাতে পারবে। কিন্তু এখন অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সেখানে আইসোলেশনে। আয় নেই। টাকা পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো মে মাসে ঈদের কারণে প্রবাসী আয় বাড়বে।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে সৌদি আরব থেকে। দেশটিতে ১৫ থেকে ২০ লাখ প্রবাসী কাজ করেন। গত অর্থবছরে শুধু সেখান থেকেই ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রবাসী আয় এসেছিল। কিন্তু এখন সেখানে অনেক বাংলাদেশি সংকটে রয়েছেন।
সৌদি আরবে দুই দশক ধরে ইলেকট্রনিক মেকানিক হিসেবে একটি ছোট্ট দোকান চালাচ্ছেন নাটোরের মোহাম্মদ আলী। তার প্রতিষ্ঠানে আরও পাঁচ জন বাংলাদেশি কাজ করেন। তারা জানালেন, করোনা সংকটের পর আগের মতো কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ আগের সঞ্চয় থেকে বা ধারদেনা করে দেশে টাকা পাঠালেও অনেকেই টাকা পাঠাতে পারছেন না।
কেবল যে আয় কমে যাওয়ায় টাকা পাঠানো কমছে তাই নয়, অনেক দেশে আবার রেমিটেন্স হাউজ বন্ধ। চট্টগ্রামের আনোয়ারার ছেলে সেলিম শাহরিয়ার কাজ করেন একটি জাপানি প্রতিষ্ঠানের জাহাজে। তিনি জানালেন, তার অফিসের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর থেকে টাকা পাঠিয়েছেন। কতো টাকা পাঠিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাড়িতে মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই সন্তান। একেবারে ১ হাজার ডলার পাঠালে দুই-তিন মাস চলে। তবে এখন করোনা সংকট, সামনে ঈদ এবং পরিবারে একজন অসুস্থ থাকায় বেশি টাকা পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রবাসী আয় আহরণের শীর্ষ ১৫টি উৎস দেশ হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, ওমান, কাতার, ইতালি, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের একটি। করোনার কারণে আয় কমলেও পাঠানোর ধারা অব্যাহত থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৩১১ কোটি ডলার। তবে বিশ্ব ব্যাংক বলছে, করোনা মহামারির কারণে এ বছর সারাবিশ্বে প্রবাসী আয় কমবে ২০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে কমবে ২২ শতাংশ। ইতিমধ্যেই সেই প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যেসব দেশ থেকে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতেন, সেসব দেশে এখনও লকডাউন চলছে। অনেক প্রবাসী করোনায় আক্রান্ত। অনেকের হাতে কাজ নেই। অনেক প্রবাসী দেশে চলে আসছেন। মে মাসে ঈদের কারণে কিছুটা হয়তো প্রবাসী আয় বাড়তে পারে। তবে সার্বিকভাবে এ বছর আয় কমবে।’
সংকট সমাধানে করণীয় কী হতে পারে জানতে চাইলে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রবাসীদের যেন চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরতে না হয় কূটনৈতিকভাবে সেই চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রবাসীরা যেখানে আছেন সেই দেশগুলোকে বোঝাতে হবে সামনে তাদের কর্মী প্রয়োজন হবে। আরেকটি বিষয়, এখন অনেকে আইসোলেশনে আছেন। কিন্তু কোনো দেশ যদি করোনামুক্ত না হতে পারে তাহলে কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ওই দেশগুলোকে বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। কাজেই অর্থনীতি বাঁচাতে হলেও স্বাস্থ্য খাতের দিকে নজর দিতে হবে।’
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ও দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি ৪০টি ব্যাংক সারা দেশে তাদের শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে প্রবাসী আয় পৌঁছে দেয় সুবিধাভোগীদের কাছে।
বৈধ পথে প্রবাসী আয় বাড়াতে গত বছরের ১ জুলাই থেকে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এখন প্রবাসীরা প্রতি ১০০ টাকা পাঠালে দুই টাকা করে প্রণোদনা পাচ্ছেন। ফলে জুলাই থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে গিয়েছিল। এখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রবাসী আয়ে মন্দা দূর করতে প্রবাসীদের পাঠানো পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কোনো যাচাই–বাছাই ছাড়াই দুই শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ। আগে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে নগদ সহায়তা দিয়ে আসছিল সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ১২ মে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কঠোর পরিশ্রম করে তারা প্রবাসী আয় পাঠান। দেশের সুসময় যেমন তারা থাকেন এই দুঃসময়েও তারা আছেন। নানা সংকটেও তারা দেশে আয় পাঠাচ্ছেন। এই সংকমটয় মুহূর্তে তাদের পাশেও আমরা থাকতে চাই। আমরা তাদের জন্য ২০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গড়ছি। যাতে তারা সহজ শর্তে ঋণ পান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে আরও ৫০০ কোটি টাকা সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। বিদেশে যারা আছেন তাদের সবাইকে আমরা বলেছি, ধৈর্য ধরে থাকুন। সংকট কেটে গেলে নিশ্চয় ভালো দিনও আসবে।’
Comments