করোনাভাইরাস পরবর্তী পৃথিবীতে ‘ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা’ থাকবে না?
করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। একেকজন করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পরপরই প্রযুক্তির সাহায্যে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সামনের দিনগুলোতে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
সিএনএনের এক প্রতিবেদন বলছে, মহামারি পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো কোনো দেশে প্রবেশের পরপরই পর্যটকদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হবে। তাদের মুঠোফোনের তথ্যও সরকার ব্যবহার করতে পারবে। হতে পারে, অন্যদেশে প্রবেশের শুরুতেই পর্যটকদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের জন্য সরকারকে অনুমতি দিতে হবে।
ইতোমধ্যেই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সব দেশেই গণহারে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। কে কার সংস্পর্শে এসেছেন, কখন, কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে মিশেছেন, বাইরে বের হওয়ার জন্য ‘যথেষ্ট সুস্থ’ আছেন কি না— এসব প্রশ্ন জরুরি হয়ে উঠেছে। অনেক দেশের ডেটাবেসে এমনকি ডিএনএর নমুনাও রাখা হচ্ছে।
মহামারির কঠিন বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোতে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা (প্রাইভেসি) কতখানি সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গত এক দশকে প্রাইভেসি লঙ্ঘন
আগের দশকে ৯/১১ হামলার পর নিরাপত্তার জন্য মার্কিন নাগরিকদের ই-মেইলে সরকারি নজরদারি বাড়ানো হয়েছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। এরপর ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কয়েক হাজার মানুষ গুগল কিংবা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ফ্রি মেসেজিং সুবিধা ব্যবহার করে। বিনা মূল্যে খবর পড়া, প্রিয়জনের ছবি আদান-প্রদান, নিজস্ব মত প্রকাশ, এমনকি ভিডিওচিত্র আদান-প্রদানেরও প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে অনেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিনা মূল্যে এসব সুবিধার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য জানতে সফল হয়।
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা জানায়, ৯/১১’র পরে সরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ব্যক্তিগত ই-মেইলে প্রবেশের পর বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাছে পর্যন্ত ব্যক্তিগত তথ্য পৌঁছে যায়।
মহামারি মোকাবিলায় ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার
বর্তমানে কোভিড-১৯’র কারণে দেশগুলোর নতুন চ্যালেঞ্জ হলো— কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং বা সম্ভাব্য আক্রান্তদের খুঁজে বের করা।
দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনার বিস্তার ঠেকাতে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার মানুষের ঠিকানা খুঁজে বের করে মুঠোফোনের মাধ্যমেই তাদেরকে দ্রুত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা বাহিনী ও সাইবার বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ তৈরি করে, যেখানে প্রত্যেকের অসুস্থতা ও তারা কাদের সংস্পর্শে গিয়েছেন সেসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। রাশিয়াসহ অনেক দেশে কিউআর কোড ব্যবহার করে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। চীন বলা চলে রীতিমতো নাগরিকদের বাড়ির দরজার সামনেও ক্যামেরা বসিয়েছে।
তবে, এক্ষেত্রে অ্যাপল ও গুগল বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। এই দুই প্রতিষ্ঠান এমন এক প্রযুক্তি তৈরির ঘোষণা দিয়েছে, যার মাধ্যমে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হবে না। ওই প্রযুক্তি যারা ব্যবহার করবেন তাদের নাম-পরিচয়ের উল্লেখ কোথাও থাকবে না। মূলত স্মার্টফোনের ব্লু-টুথ সিগন্যাল ব্যবহার করে কোনো করোনাভাইরাস আক্রান্ত মানুষের কাছে কেউ গিয়েছিল কি না ও কত সময় পর্যন্ত সেখানে ছিলেন, তা জানা যাবে।
কারো কোভিড-১৯ শনাক্ত হলে তার কাছাকাছি আসা অন্য মানুষদের স্মার্টফোনে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে সেটি জানিয়ে দেওয়া হবে। স্মার্টফোনে কোনো জিপিএস লোকেশন ডাটা বা ব্যক্তিগত তথ্য রেকর্ড করা হবে না।
রোগের বিস্তার ঠেকাতে প্রযুক্তির সম্ভাবনা ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর কোভিড-১৯’র প্রভাবকে ‘নজিরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেছে প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনাল।
প্রাইভেসি ইন্টারন্যাশনালের ক্যাম্পেইন গ্রুপের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর এডিন ওমানোভিক বলেন, ‘৯/১১ এর সময়ে গোপন ও প্রকাশিত তথ্য যাচাইয়ের জন্য যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার অনেকগুলোই ছিল আইনবিরোধী।’
৯/১১’র মতো কোভিড-১৯’র কারণেও মানুষের প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করা এক ধরনের বৈধতার সুযোগ পাবে। কারণ, মানুষ এ রোগ প্রতিরোধের জন্য সরকারকে সাহায্য করতে চায়।
এডিন বলেন, ‘স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করা আর নিরাপত্তা বিভাগকে এর ভিত্তিতে ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারে সুযোগ দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে।’
মার্কিন সরকার অস্বীকার করলেও এ কথা সত্য যে, ৯/১১’র পরে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যে প্রাইভেসি লঙ্ঘন হয়েছিল সেটা স্থায়ী হয়েছে। এখনো চালু আছে।
সরকার নিয়মিতভাবে ব্যাপক মানুষের ই-মেইল ও ফোনের তথ্য ব্যবহার করতে পারছে। এ কারণে নিরাপত্তা বিভাগের দ্বারা গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা আদৌ প্রশ্নের মুখে পড়ছে কি না, তা স্পষ্টভাবে বলা যায় না।
আস্থা অর্জন কি আদৌ সম্ভব?
২০১১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ইনফ্লুয়েঞ্জা মনিটরিং মোবাইল অ্যাপ চালু করে। ওই প্রকল্পের এক জন অধ্যাপক জন ক্রোক্রফট। তিনি বলেন, ‘সরকারকে তাদের প্রয়োজন সম্পর্কে স্পষ্ট হতে হবে। জনগণকেও সেটা জানাতে হবে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে একটা নির্ধারিত সময়ের পর ডেটা মুছে ফেলতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট সময়, ধরি ৩০ দিন পর যখন তথ্যগুলো কোনো কাজে আসবে না তখন তা মুছে ফেলতে হবে। তথ্যগুলো মহামারির বিশেষজ্ঞদের মডেলে ঢুকে পড়ার পর আলাদা করে কারও ব্যক্তিগত তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন হয় না। মহামারির বিশেষজ্ঞদের মডেলেই তা সমষ্টির তথ্য হিসেবে সংরক্ষিত থাকে। এর মাধ্যমে জনগণের প্রাইভেসিকে শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করা সম্ভব।’
আশঙ্কা ও উদ্বেগ
শোশানা জুবফের বই ‘দ্য এজ অব সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ এ টেক প্রতিষ্ঠান যারা গত দুই দশকে বিপুল পরিমাণে ডেটা সংগ্রহ করেছে, তাদের অর্জিত ক্ষমতা ও সম্পদের বর্ণনা এসেছে।
তিনি মনে করেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দৈত্যাকার টেক প্রতিষ্ঠানগুলো আধিপত্য টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি প্রাইভেসি লঙ্ঘন করেও মানুষের সমর্থন পাবে।
তিনি জানান, আপনি বিনা মূল্যে ব্যবহার করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো কয়েক হাজার কোটি ডলার আয় করে। কারণ, আপনার জীবনযাপন নিয়ে তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে, আপনার তথ্যগুলো তাদের কাছে উন্মুক্ত। ফলে, আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী বাণিজ্যিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনও তারা আপনাকে দেখায়।
প্রাইভেসির উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মানুষ প্রতি মাসে ফেসবুক ব্যবহার করে।
ফলে, আগামীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার খাতিরে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ব্যাপারে সংবেদনশীল মানুষও প্রাইভেসি লঙ্ঘন মেনে নিতে পারে। আগামী বছরগুলোতে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে।
Comments