প্রবাস

করোনা মোকাবিলায় ইউরোপে সফল স্লোভেনিয়ার গল্প

নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনও যুদ্ধ নয়, নয় কোনও ধরণের সামরিক অভিযান কিংবা কোনও ধরণের পারমাণবিক অভিযান, অতি ক্ষুদ্র এক ধরণের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়।
Ljubljana
স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা।

নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ নিঃসন্দেহে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের নাম। কোনও যুদ্ধ নয়, নয় কোনও ধরণের সামরিক অভিযান কিংবা কোনও ধরণের পারমাণবিক অভিযান, অতি ক্ষুদ্র এক ধরণের আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবী অসহায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২১২টি দেশ ও অঞ্চলে এ প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণের প্রমাণ মিলেছে। প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষ এ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন, ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ।

চীনের ইউহান থেকে শুরু করে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র নিষ্ঠুর থাবা বসিয়েছে এ প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস।

মধ্য ইউরোপে অবস্থিত ৭ হাজার ৮২৭ বর্গমাইলের ছোট দেশ স্লোভেনিয়া। সর্বশেষ ২০১৮ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশটিতে সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লাখ লোকের বসবাস। সুউচ্চ আল্পস পর্বতমালা, বিভিন্ন ধরণের হ্রদ, ব্রাউন বিয়ার ও স্কি রিসোর্টের জন্য দেশটি পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়।

করোনার ছোবল থেকে নিষ্কৃতি পায়নি ইউরোপের ছোটো ও সুন্দর এ দেশটি। তবে পার্শ্ববর্তী ইতালি কিংবা ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন— স্পেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনার সংক্রমণের হার বরাবরই কম।

এমনকী, মৃত্যুর হার বিবেচনায়ও ইউরোপের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়া রয়েছে সবচেয়ে নিম্ন অবস্থানে। তবে স্লোভেনিয়া আমাদের দেশের মানুষের কাছে তেমন পরিচিত না হওয়ায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ইউরোপের এই দেশটি নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না।

গত ১৫ মে ইউরোপের প্রথম কোনও দেশ হিসেবে করোনা মহামারির পরিসমাপ্তির ঘোষণা করে স্লোভেনিয়া। দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইয়ানেজ ইনশার পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ইউরোপের প্রথম কোনও দেশ হিসেবে গত ১২ মে সব ধরণের ফ্লাইট চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় স্লোভেনিয়া।

এছাড়াও, গত ১১ মে থেকে দেশটিতে বাস, ট্রেনসহ সব গণপরিবহন চলাচলের ওপর বিধিনিষেধও তুলে নেওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহ থেকেই রেস্টুরেন্ট, বার, কফিশপকে খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

স্লোভেনিয়ার ভেতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাফেরায় এখন আর কোনও বাধা নেই।

আগামীকাল ১৮ মে থেকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ২৩ মে থেকে মাঠে গড়াচ্ছে সব ধরণের ফুটবল ম্যাচ।

মে মাসের শেষের দিকে যথাসময়ে স্টেস্ট মাতুরা এক্সাম অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটিকে আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ওয়ার্ডোমিটারসডটকমের তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় স্লোভেনিয়ায় নতুন কেউ করোনায় সংক্রমিত হননি এবং এ ভাইরাসের প্রভাবে প্রাণহানিও ঘটেনি।

পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও স্লোভেনিয়া সরকার সীমান্ত সংযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রাথমিক অবস্থায় বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন কোনও দেশের নাগরিক যদি স্লোভেনিয়াতে প্রবেশ করে তাহলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের কোয়ারান্টাইনে থাকতে হবে। তবে ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্যে এ ধরণের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ইউরোপে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে থাকা দেশটি ছিল ইতালি। অথচ ইতালির প্রতিবেশি রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে স্লোভেনিয়া সফলভাবে এই মহামারি মোকাবিলা করলো? কেনই বা ইউরোপ এমনকী পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে সে অর্থে করোনার বিস্তৃতি ঘটেনি? এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, স্লোভেনিয়ায় রয়েছে বিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা। পৃথিবীর অনেক দেশের ক্ষেত্রে আমরা যেটা লক্ষ্য করি যে দেশটিতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা একটি নির্দিষ্ট শহর কেন্দ্রিক। হতে পারে সেটি দেশটির রাজধানী শহর, আবার হতে পারে সেটি দেশটির বৃহত্তম কোনও একটি নগরী। যেমন, আমাদের বাংলাদেশের কথা বলতে পারি। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে দেড় কোটির বেশি মানুষ বসবাস করেন রাজধানী ঢাকায়। আমাদের দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজ ঢাকাকে ঘিরে। আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকরা বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের লোকজন সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ঢাকায় এসে স্থায়ী হতে চান।

আবার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম এ দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৩ কোটির মতো। ব্রাসিলিয়া দেশটির রাজধানী হওয়া সত্ত্বেও দেশটির মানুষের জীবনযাত্রা অনেকটা সাও পাওলো ও রিও ডি জেনিরোকে ঘিরে। তাই জনবসতির বিবেচনায় ব্রাজিলের এ দুই শহর দেশটির অন্যান্য শহরগুলোর তুলনায় বেশি ঘনবসতিপূর্ণ।

স্লোভেনিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি এ রকম নয়। স্লোভেনিয়ার রাজধানীর নাম লুবলিয়ানা। এটি একই সঙ্গে দেশটির বৃহত্তম নগরী। তবে স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবন শুধুমাত্র লুবলিয়ানাকেন্দ্রিক নয়। দেশটির প্রায় সর্বত্র জনবসতির বণ্টন রয়েছে। সমগ্র স্লোভেনিয়া সুউচ্চ আল্পস ও ডিনারাইডস পর্বতমালা দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় স্লোভেনিয়াতে জনবসতির এ বণ্টন অনেকটা ছড়ানো ছিটানো।

স্লোভেনিয়ার প্রত্যেকটি মিউনিসিপ্যালিটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কাউকে এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাওয়ার তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এমনকী, স্লোভেনিয়াতে আমার বসবাস ভিপাভাতে।  আক্ষরিক অর্থে ভিপাভা একটি নিভৃত পল্লি। ছোটো এ এলাকাতেই আমার জীবনের সব প্রয়োজনীয় চাহিদা ভালোভাবে পূরণ করা সম্ভব।

করোনা মহামারি বিস্তার প্রতিরোধে স্লোভেনিয়ার সরকার গত ১৭ মার্চ থেকে স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থায় নিয়ে আসে। বিশেষ অনুমতি ছাড়া এক মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অন্য মিউনিসিপ্যালিটিতে যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়। বিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে মানুষের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে বিশেষ করে লুবলিয়ানা, মারিবোর, ছেলইয়ে, ক্রানিয়ের মতো বড় শহরগুলোতে যাওয়ার তেমন প্রয়োজন পড়েনি।

স্লোভেনিয়া উত্তর দিকে অস্ট্রিয়া, উত্তর-পূর্বে হাঙ্গেরি, দক্ষিণ-পূর্বে ক্রোয়েশিয়া, পশ্চিমে ইতালি এবং দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের শাখা আড্রিয়াটিক সাগরের সঙ্গে যুক্ত। করোনা পরিস্থিতির কারণে গোটা ইউরোপে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে ছিলো ইতালি ও স্পেন। সে হিসেবে স্লোভেনিয়ার ইতালি-সীমান্তবর্তী অংশে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু, স্লোভেনিয়ার সে অংশে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় করোনায় সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে কম।

পুরো স্লোভেনিয়াতে যখন করোনা রোগীর সংখ্যা প্রায় এক হাজার তখন সেখানে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। ইতালিতে করোনা পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করার সময় স্লোভেনিয়া সরকারের সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলেস শাবেদার স্লোভেনিয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেন।

ঐতিহাসিকভাবে ইতালি ও স্লোভেনিয়া বিভিন্নভাবে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা হলেও প্রকৃতপক্ষে ইতালির ত্রিয়েস্তে ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শহর। সেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্লোভেনিয়ান জাতিগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিলো।

এছাড়াও, স্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার আড্রিয়াটিক সাগরের উপকূলবর্তী এলাকা যেমন— কপার, ইজোলা, পোর্তোরস কিংবা ক্রোয়েশিয়ার পুলা অথবা পরেচ— এ সব জায়গায় প্রচুর সংখ্যক ইতালিয়ানদের বসবাস রয়েছে।

এমনকী, এ সব জায়গায় যারা স্থায়ী হন তাদেরকে স্লোভেনিয়ান অথবা ক্রোয়েশিয়ান এবং ইতালিয়ান ভাষায় দক্ষ হতে হয়। এ সব জায়গার শিক্ষা-প্ৰতিষ্ঠানগুলোও উভয় ভাষায় পাঠদান করে থাকে।

এছাড়াও, সাগরের তীরবর্তী এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোতে সব সময় জনসমাগম থাকে। কিন্তু, ইতালিতে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে না করতে স্লোভেনিয়ার সরকার সর্বপ্রথম এ অঞ্চলগুলোতে মানুষের অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেয়।

সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের জমায়েতকে কমিয়ে আনার জন্য স্পেশাল পুলিশ ফোর্স মোতায়ন করা হয়। পাশাপাশি, ইউনিভার্সিটি অব প্রিমোরস্কাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

গত ৪ মার্চ স্লোভেনিয়াতে সর্বপ্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত করা হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি মরক্কো থেকে ইতালি হয়ে স্লোভেনিয়াতে এসেছিলেন।

স্কি স্লোভেনিয়ার একটি জনপ্রিয় খেলা এবং দেশটির বেশির ভাগ মানুষ স্কির প্রতি আসক্ত। স্থানীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, স্লোভেনিয়াতে সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে যাদের শরীরে কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে তাদের একটি বড় অংশ কয়েক দিন আগে ইতালিতে গিয়েছিল স্কি খেলতে।

যেহেতু, স্লোভেনিয়াতে করোনা এসেছিল ইতালি থেকে এবং একই সঙ্গে ইতালিতে যখন করোনার সংক্রমণ সবচেয়ে তীব্র, ঠিক তখনই স্লোভেনিয়ার সরকার ইতালির সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। ইতালি থেকে যারা স্লোভেনিয়াতে আসেন তাদের সবাইকে মেডিকেল চেক আপের আওতায় আনা হয়। তাদেরকে আইসোলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পরবর্তীতে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও একই উদ্যোগ নেওয়া হয়। মার্চের ১৯ তারিখ থেকে স্লোভেনিয়াতে বাস-ট্রেনসহ সব ধরণের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজধানী লুবলিয়ানাতে অবস্থিত দেশটির একমাত্র বিমানবন্দর ইয়োজে পুচনিক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকেও সব ফ্লাইট স্থগিত করে দেওয়া হয়।

বিভিন্ন ধরণের কার রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ট্যাক্সি সেবার ক্ষেত্রে যদিও কোনও ধরণের বিধিনিষেধ ছিলো না তবে ট্যাক্সিচালকদের বলা হয় প্রত্যেকবার যাত্রী বহনের শেষে তাদের ট্যাক্সিগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে যাতে করোনার বিস্তার প্রতিহত করা সম্ভব হয়।

স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে স্লোভেনিয়াকে জরুরি অবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখনও স্লোভেনিয়াতে করোনা পরিস্থিতি খুব একটা জটিল পর্যায়ে পৌঁছায়নি। শিশুদের মধ্যে করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল থাকায় সবার আগে স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

সব ধরণের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে জানানো হয় যে কোনও পাবলিক প্লেসে যাতায়াতের সময় সবাইকে মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরতে হবে। পারস্পরিক দেড় মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কেউ যদি তাদের এ নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তাহলে তাকে ন্যূনতম ৪০০ ইউরো জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

লুবলিয়ানা, মারিবোর, ক্রানিয়ে, ছেলইয়ের মতো বড় শহরগুলোতে পুলিশ প্রশাসনকে যতটা সম্ভব কড়া অবস্থানে থাকতে দেখা গিয়েছে যাতে এ সব শহরে বসবাসরত জনসাধারণ এ নির্দেশনা যথাযথভাবে মেনে চলতে পারে।

স্লোভেনিয়ার সরকার তো বটেই এমনকী দেশটির সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্যাংক, পোস্ট অফিস, সুপার শপ, খাবারের দোকান, পেট্রোল স্টেশন, হাসপাতাল, ফার্মেসি অর্থাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় সেবামূলক যে সব প্রতিষ্ঠান এ অবস্থার মধ্যেও কাজ করে গিয়েছে সব প্রতিষ্ঠানে এক সঙ্গে একজন কিংবা একই পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।

প্রথম দিকে অবশ্য মাস্ক ও হ্যান্ড গ্লাভস পরা না থাকলে কাউকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হতো না। পরবর্তীতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে গ্লাভসের বাধ্যবাধকতা শিথিল করে নেওয়া হয়। তবে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবস্থা করা হয়।

দেশটির প্রশাসনের পক্ষ থেকে থেকে জানানো হয়, পরিস্থিতি যতদিন না স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে ততদিন পর্যন্ত সবাইকে এ সব প্রতিষ্ঠানের ভেতর প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই বাধ্যতামূলকভাবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।

করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও যে সব ফ্যাক্টরি তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করেছে, তাদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি ফ্যাক্টরিতে থার্মাল স্ক্যানারের ব্যবস্থা ছিল যাতে নিয়মিত ফ্যাক্টরির অধীনে কাজ করা সবাইকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যায়।

এছাড়াও, স্লোভেনিয়ার সরকার স্পেশাল হটলাইন চালু করে। কারো শরীরে ব্যথা, সর্দি, কাশি, জ্বরসহ কোভিড-১৯ এর কোনও উপসর্গ দেখা দিলে তাকে তৎক্ষণাৎ হটলাইনের তিনটি নম্বরের যে কোনও একটিতে ফোন দিতে বলা হয়। প্রত্যেক মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় বিশেষ নম্বরের লোগো সম্বলিত বিশেষ গাড়ি টহলে নিয়োজিত ছিল যা এখনও তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

কেউ যদি মনে করেন যে তার শরীরে কোভিড-১৯ এর কোনও লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে ততক্ষণাৎ স্থানান্তর করার জন্য সব সময় বিশেষ গাড়িটি কাজ করছে।

আগে থেকে সতর্কতা ও একই সাথে কার্যকরি উদ্যাগ গ্রহণ করায় স্লোভেনিয়াতে করোনায় মৃত্যুর হার তুলনামূলক কম। গত ১৫ মে পর্যন্ত স্লোভেনিয়ায় করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬৫ জন এবং মারা গেছেন ১০৩ জন। যারা মারা গেছেন করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ছিলো ৬৭ এর ওপরে। তাদের অনেকের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অ্যাজমাসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা ছিল বলে স্লোভেনিয়ার গণমাধ্যম জানায়।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ২৪ দশমিক ১ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৯ এর মধ্যে। এছাড়াও, সরকারের ঘোষিত আর্থিক ব্যবস্থা দেশটির সাধারণ মানুষের বেশ প্রশংসা পেয়েছে। কৃষক ও পেনশনভোগীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদেরকে মাসে ১৫০ ইউরো করে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে যাদের কাজ নেই তাদেরকে বেতনের ৮০ শতাংশ করে দিতে বলা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

তবে একটি বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গিয়েছে আর সেটি হচ্ছে স্লোভেনিয়াতে যে সব বিদেশি নাগরিক রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া সরকারের ঘোষিত সুস্পষ্ট কোনও নীতিমালা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

বর্তমানে করোনার চিকিৎসায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্টেম সেল থেরাপির কথা বলা হচ্ছে। স্টেম সেল নামক এক বিশেষ ধরণের কোষ রয়েছে যা আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। স্টেম সেলকে মেমোরি সেল হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়।

আমরা যখন কোন রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠি পরবর্তীতে যখন ঐ একই ধরণের রোগ-জীবাণু আমাদের শরীরে আক্রমণের চেষ্টা করে তখন স্টেম সেল আগের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সে সব জীবাণুকে শনাক্ত ও ধ্বংস করে ফেলে।

বর্তমানে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় আলোচিত এ স্টেম সেল থেরাপিতে বলা হচ্ছে সম্প্রতি কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়েছেন এমন কোনও ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরস আক্রান্ত অন্য কোনও ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

করোনার চিকিৎসায় স্টেম সেল থেরাপি নিয়ে যে সব ইনস্টিটিউট গবেষণা করেছে তার মধ্যে স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব ইমিউনোলজি এবং ডিপার্টমেন্ট অব ভাইরোলজির অন্যতম। এদের সমন্বিত গবেষণালব্ধ ফলাফল অনেক দেশ এখন অনুসরণ করার চেষ্টা করছে।

এছাড়াও স্লোভেনিয়ার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথও করোনা প্রতিরোধে কার্যকরী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তুত করা ভ্যাকসিনের নমুনা পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

স্লোভেনিয়াতে বলতে গেলে এখন সব কিছুই স্বাভাবিক। তবে প্রধানমন্ত্রী ইযানেজ ইনশা বারবার বলছেন, বাইরে থেকে পরিস্থিতি যতই স্বাভাবিক মনে হোক না কেনও, বাস্তবিক অর্থে সব কিছু তার আগের অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে। বিশেষত দেশটির অর্থনীতির ওপর বিশাল চাপের সৃষ্টি হবে।

চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল সাড়ে তিন শতাংশ। সম্প্ৰতি স্লোভেনিয়ার ইনস্টিটিউট অব ম্যাক্রোইকোনোমিক অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশটির এ আর্থিক প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে অর্থাৎ দেড় শতাংশে নেমে আসতে পারে।

স্লোভেনিয়ান টাইমস পত্রিকায় বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে দেশটিতে ১১ হাজারের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়েছে তাদের পরিসরকে সঙ্কুচিত করতে। করোনা মহামারির অবসান হলেও স্লোভেনিয়া সরকারের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এ পরিস্থিতির ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কাটিয়ে ওঠা।

স্লোভেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সবাইকে যথাসম্ভব সতর্ক থাকার আহবান জানানো হয়েছে। তার মতে, যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করলে যে কোনও মুহূর্তে মহামারির চেহারা বদলে গিয়ে গত শতাব্দীর ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র মতো মহামারি দ্বিতীয় ধাপে শুরু হতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব লুবলিয়ানার মেডিকেল সেন্টারের সংক্রামকব্যাধি বিশেষজ্ঞ ম্যাটেয়া লোগারের মতে, স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসের মহামারি পরিস্থিতির অবসান ঘটেছে। কিন্তু, তাই বলে করোনা এ দেশ থেকে একেবারে নির্মূল হয়েছে এমনটি নয়।

তিনি বলেন, দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সবাই এখনও সুস্থ না হওয়ায় এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে করোনা মহামারি অবসানের ঘোষণা না পর্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা থেকে যাচ্ছে।

এছাড়াও, দেশটির অনেক বিশেষজ্ঞের মনে করেন, আগামী সেপ্টেম্বরের দিকে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় ইউরোপ কিংবা আমেরিকায় ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণের হার বেশি থাকে। তাই সে সময় দ্বিতীয় ধাপে করোনার সংক্রমণ সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। পুরো পৃথিবীর অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য তারা পরামর্শ দিয়েছেন।

অপেক্ষাকৃতভাবে নতুন রাষ্ট্র স্লোভেনিয়া। দেশটি ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রতিবেশী ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়া অথবা পশ্চিম ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে বেশ পিছিয়ে রয়েছে স্লোভেনিয়া। জনসংখ্যা অনুপাতে দেশটিতে ভ্যান্টিলেশন খুব বেশি নেই। শুধুমাত্র সরকারের উদ্যোগ, দেশটির সাধারণ মানুষের সচেতনতা, মানসিক দৃঢ়তা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিপক্ষে দেশটিকে জয়ী করেছে।

রাকিব হাসান, শিক্ষার্থী, ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

6h ago