করোনায় আগামীর ভাবনা: ‘ভিডিও সম্পাদনা’ সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার
নতুন করোনাভাইরাস কোভিড-১৯’র কারণে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানব প্রাণ আজ এমন এক স্থবিরতা আর নীরবতার সম্মুখীন— যেটা মানবসভ্যতা এর আগে কোনোদিন দেখেছে বলে জানা যায় না। শহুরে জীবনে শান্ত-স্নিগ্ধতার আবেশ বহুল কাঙ্ক্ষিত হলেও সেটা এই মুহূর্তে সবার কাছেই অনাকাঙ্ক্ষিত! আমরা মানুষেরা এখন ঘরবন্দি। থেমে গেছে পৃথিবীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর সেই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। নিশ্চয় একদিন এই পরিস্থিতির ইতি ঘটবে, সূচনা হবে নতুন বিশ্বের। কিন্তু বিষয় হলো— করোনা পরবর্তী সেই বিশ্ব কেমন হবে?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই করোনা বৈশ্বিক মহামন্দায় রূপ নেবে। এরপর করোনা পরবর্তী বিশ্ব হবে একদমই নতুন। দক্ষতার মানদণ্ড হবে ভিন্ন রকম। কিছুদিন আগে থেকে শুরু হওয়া ইন্টারনেট-নির্ভর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যে আলোচনা চলছিল, করোনা সংকট সেটার বাস্তবায়ন এক লাফে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাসায় বসে কাজ করার ধারণা আমাদের দেশেও এই ক’দিনে পোক্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অথচ মাসখানেক আগেও এটা ছিল অভাবনীয় একটা ব্যাপার। আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট অব থিংস অথবা ব্লক চেইন প্রযুক্তি— এগুলোই সামনের দিনে প্রভাব বিস্তার করবে।
সেই নতুন দুনিয়ায় ভিডিও সম্পাদনায় দক্ষতা আপনার জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। চলমান ঘরে থাকার একঘেয়েমি মুহূর্তগুলোকে ভিডিও সম্পাদনা শেখার মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেন। একবার শিখলেন তো আপনাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। প্রযুক্তিনির্ভর এই দক্ষতা আপনার ক্যারিয়ারকে এক ধাপ এগিয়ে নেবে নিঃসন্দেহে। ভিডিও সম্পাদনা এমন একটি পেশা, যার মাধ্যমে বৈশ্বিক অঙ্গনে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। খ্যাতি, সুনাম, পরিচিতির সঙ্গে রয়েছে সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি।
একজন ভিডিও সম্পাদকের কাজ হলো— চিত্রগ্রাহকদের ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ এডিটিং সফটওয়্যারের সাহায্যে কেটেকুটে দর্শকদের দেখার উপযোগী করে তোলা। পড়াশুনা ও অন্যান্য পেশায় থেকেও ভিডিও সম্পাদনা পেশায় নিযুক্ত হয়ে আপনি আয়ের উৎস বাড়াতে পারেন। ভিডিও সম্পাদনার মাধ্যমে আপনার সৃজনশীল কাজ দিয়ে চমকপ্রদ এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেই পারেন।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ৩০-৩৫টি টিভি চ্যানেল রয়েছে। সবগুলো টিভি চ্যানেলেই প্রয়োজন দক্ষ ভিডিও সম্পাদক। টিভি চ্যানেলগুলোতে সংবাদের পাশাপাশি অসংখ্য অনুষ্ঠান, নাটক, ম্যাগাজিন, বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। এসব অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেল ছাড়া অনেক প্রযোজনা সংস্থাও নির্মাণ করে থাকে। তাই পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন— দুইভাবেই ভিডিও সম্পাদক হিসেবে কাজ করা যায়।
একেকটি টিভি চ্যানেলে ২৫ থেকে ৫০ জন ভিডিও সম্পাদকের দরকার হয়। তার মানে আনুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ একেবারে কম নয়। আর আপনি যদি দক্ষ আর সৃজনশীল হন, তাহলে সেটা আপনার জন্য শাপে বর। আপনাকে কখনো কর্মহীন থাকতে হবে না। একটা টিভি চ্যানেলে সাধারণত পাঁচটি ক্যাটাগরিতে ভিডিও সম্পাদক নেওয়া হয়। যেমন: ১. ভিডিও সম্পাদক ইনচার্জ, ২. সিনিয়র ভিডিও সম্পাদক, ৩. ভিডিও সম্পাদক, ৪. জুনিয়র ভিডিও সম্পাদক ও ৫. শিক্ষানবিশ ভিডিও সম্পাদক।
একজন ভিডিও সম্পাদক মাসিক পারিশ্রমিক হিসেবে শুরুতে ২৫-৩০ হাজার এবং পরবর্তী সময়ে তা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকাও হতে পারে। যত বেশি চ্যানেল, তত বেশি নাটক, সিনেমা আর বিজ্ঞাপন। এর মানে হলো— আপনার দক্ষতা যদি ভালো হয়, তাহলে আনুষ্ঠানিক খাতেও কাজের ভালো সুযোগ আছে।
কীভাবে শুরু করবেন?
বাংলাদেশে অনেক ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। কিন্তু, করোনার এই সময়ে দূরে থাকাই যখন জরুরি, তখন আনুষ্ঠানিক আবহে শেখার সেই সুযোগ নেই। তবে, এই সমস্যা কাটাতে ইউটিউবের টিউটোরিয়াল ভিডিও আপনার জন্য হতে পারে ভালো একটা মাধ্যম। এগুলো দেখেও মোটামুটি আয়ত্তে আনতে পারবেন। আর সৃজনশীলতা? সেটার জন্য আপনি পৃথিবীর বিখ্যাত সব ভিডিও সম্পাদক বা প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো দেখতে পারেন। নিয়মিত বিখ্যাত ডকুমেন্টারি, সিনেমা বা যেকোনো কিছু মন দিয়ে দেখুন; কীভাবে বিচ্ছিন্ন দৃশ্যগুলোকে সাজিয়ে একটা সুন্দর চলমান গল্পে রূপ দেওয়া হয়। এতে আপনার মাথা খুলে যাবে। কথায় আছে— শোনা বা পড়ার চাইতে দেখে দেখে শেখাটা বেশি কার্যকরী।
কী কী সফটওয়্যার আর কেমন ধরনের কম্পিউটার দরকার?
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব সফটওয়্যার ভিডিও সম্পাদনার কাজে বেশি ব্যবহৃত হয়, সেগুলো হলো— অ্যাডোব প্রিমিয়ার প্রো, এডিয়াস, ফাইনাল কাট প্রো (এফসিপি) ইত্যাদি। তবে, দুই-একটি চ্যানেলে ভ্যালোসিটি ও ভেগাজ প্রো ব্যবহার করা হলেও এগুলো এখন বিলুপ্তির পথে।
এগুলোর জন্য মাঝারি মানের কম্পিউটার হলেই চলে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে হার্ডওয়্যার, সেটা হলো— র্যাম। ভিডিও এডিটিংয়ের জন্য র্যাম চার জিবি হলেই যথেষ্ট। তবে, আরও বেশি হলে আরও ভালো।
আর কম্পিউটার না থাকলে আপনার স্মার্টফোনেই ছোটখাটো কাজ করতে পারেন। হতে পারে এটা আপনার হাতেখড়ি। এর জন্য প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোর থেকে সফটওয়্যার নামিয়ে কাজ করতে পারেন।
মাল্টিমিডিয়া জগতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃত, সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা তত বেশি। তাই আপনার মেধা, শৈল্পিক আর নান্দনিক মানসিকতায় এই পেশাকে আপন করে নিতে পারেন। শুধুমাত্র কিছুদিনের প্রশিক্ষণেই আপনার বেকারত্ব-হতাশা-দারিদ্র্য স্থায়ীভাবে কেটে যেতে পারে। আপনি একজন দক্ষ ভিডিও সম্পাদক হওয়া মানে আপনাকে কাজ খুঁজতে হবে না; কাজই আপনাকে খুঁজবে। আপনার আগামী জীবন হতে পারে সুন্দর-সাফল্যময়।
এজন্য চাই স্থির চিন্তাশক্তি ও অটুট অত্মবিশ্বাস। প্রযুক্তি আপনার জন্য; আপনি প্রযুক্তির জন্য। তো শুরু করুন, এখনই, লকডাউনের স্থবির সময়গুলোই হবে আপনার মূল্যবান বিনিয়োগ!
লেখক: এমএ রশিদ, ভিডিও সম্পাদক, দুরন্ত টিভি
Comments