কুড়িগ্রামের হাল না ছাড়া কাপড় ফেরিওয়ালা আনোয়ারা

বাইসাইকেলে চড়ে বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে কাপড় বিক্রি করেন আনোয়ারা। ছবি: স্টার

কেউ ডাকেন ‘ফেরিওয়ালা আপা’ আবার কেউ ডাকেন ‘কাপড়ের ফেরিওয়ালা’ বলে। আসল নাম হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। তাতে বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই তার। বরং খুশিই হন হাল না ছাড়া নারী আনোয়ারা বেগম (৩৭)।

প্রত্যন্ত গ্রামে নারী সংগ্রামের সফল উদাহরন স্থাপন করেছেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের মহিধর গ্রামের এই নারী। লালমনিরহাট সদর উপজেলা ও কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ২০টি গ্রামে দেখা মেলে তার। বাইসাইকেলে চড়ে বাড়ি বাড়ি ঘুড়ে কাপড় বিক্রি করেন আনোয়ারা।

দুই ছেলেকে নিয়ে জীবন-জীবিকায় দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না আনোয়ারার। দিনমজুর বাপের বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে দিন কাটতে থাকে অনাহারে-অর্ধাহারে। একমুঠো খাবারের জন্য সন্তানদের কান্না তাকে প্রতিনিয়ত অশ্রুসিক্ত করতো। কিন্তু নিরুপায় আনোয়ারা শুধই নিরবে কেঁদে গেছেন।

পড়াশুনা না জানা দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আনোয়ারা বেগমকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলায় মকবুল হোসেন নামে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। তাদের ঘরে জন্ম নেয় দুই সন্তান। কিন্তু সেখানে সংসার স্থায়ী হয়নি তার। যৌতুকের দাবী মেটাতে না পারার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে আনোয়ারার। সন্তানদের নিয়ে ঠাঁই হয় বাপের বাড়ীতে। আনোয়ারার বয়স অল্প, তাই বাবা-মা গ্রামের মানুষদের সহায়তায় আবার বিয়ে দেন আনোয়ারার। রাজারহাট উপজেলায় এই স্বামীর বাড়ীতেও সংসার হয়নি তার। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে ফের যৌতুকের টাকার জন্য সংসার ভাঙ্গে তার। চলে আসেন বাপের বাড়িতে।

২০০৭ সালে তার জীবনে রচিত হয় নতুন অধ্যায়। হাতে জমানো ২ হাজার টাকায় কাপড় কিনে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। প্রথম দিকে গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে কাপড় বিক্রি করতেন তিনি। এতে খুব বেশি দূর ঘুরতে পারতেন না। একবছর পর শিখে নেন বাইসাইকেল চালানো। কেনেন একটি পুরাতন বাইসাইকেল। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ সেরে বাইসাইকেলে চড়ে আনোয়ারা বেড়িয়ে পড়েন কাপড় বিক্রি করতে। দিনভর কাপড় বিক্রি করে বিকালে বাড়ি ফিরেন। এখন তার ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। প্রায় ৫০ হাজার টাকার কাপড় নিয়ে ঘোরেন তিনি। ২০টি গ্রামের মানুষকে চেনেন তিনি, তাকেও সবাই চেনেন। আড়াই লাখ টাকারও বেশি বাকি পড়ে গেছে গ্রামের মানুষের কাছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের কাপড় বিক্রি করেন আনোয়ারা। বাজার মুল্যের সমান দামে তিনি কাপড় বিক্রি করায় গ্রামের মানুষ তার কাছ থেকেই কাপড় কেনেন। প্রতিদিন গড়ে ১২-১৫ হাজার টাকার কাপড় বিক্রি করেন আনোয়ারা। আর এতে তার আয় হয় প্রায় ১২-১৫শ টাকা।

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ সেরে বাইসাইকেলে চড়ে আনোয়ারা বেড়িয়ে পড়েন কাপড় বিক্রি করতে। ছবি: স্টার

আনোয়ারা এর মধ্যেই মহিধর বাজারে তিন শতাংশের একখন্ড জমি কিনে তার উপর পাকা ঘর তুলেছেন। ঘরের সামনের অংশ ব্যবহার হচ্ছে কাপড়ের দোকান হিসেবে আর পিছনের অংশে তিনি বাস করেন ছেলেদের নিয়ে। বড় ছেলে আরিফুল ইসলাম কলেজে পড়ে আর ছোট ছেলে কাজল ইসলাম পড়ে স্কুলে। পড়াশুনার ফাঁকে কাপড়ের দোকানে বসে ব্যবসাও করে তারা। সংগ্রামের সংসারটিকে দাঁড় করিয়ে সুখসমৃদ্ধ করেছেন আনোয়ারা বেগম।

আনোয়ারার দুই ছেলে আরিফুল ও কাজল জানায়, তাদের মা বাইসাইকলে চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুড়ে কাপড় বিক্রি করে আয় করেন, এতে তারা গর্বিত। তাদের জীবনে মা-ই সব, পিতার কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা সংগ্রামী মাকে সহযোগিতা করছে, তারাও দোকানে কাপড় বিক্রি করছে। এতে সম্মান কমছে না, বরং সম্মান বাড়ছে। তাদের জীবনে এসেছে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার সিন্দুরমতি গ্রামের গৃহবধু মোসলেমা বেগম (৪২) জানান, ফেরিওয়ালা আপা তাদের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘তার কাছ থেকে বাকি ও নগদে কাপড় কিনি। তিনি কখনো খারাপ কাপড় দেননি আর দামও বেশি নেননি। ফেরিওয়ালা আপার কাছ থেকেই আমরা সংগ্রামী হওয়ার মন্ত্রনা পাই।’

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মহিধর গ্রামের আজিজার রহমান (৭৫) জানালেন, অনেকে এমনকি তিনিও প্রথম দিকে আনোয়ারাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেননি। কিস্তু সেই আনোয়ারা এখন তাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘আনোয়ারাই শিখালো নারীদের সংগ্রামী হতে, জীবনকে প্রতিষ্ঠা করতে। আমরা এখন আনোয়ারাকে স্যালুট জানাই।’

‘সংগ্রামী আনোয়ারা বেগম হাল ছাড়ার মানুষ নন। তাই তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার কাপড়ের ব্যবসা দিন দিন উজ্জ্বল হচ্ছে। আমরা পুরুষরাও আনোয়ারার কাছে সংগ্রামী হতে অনেক কিছু শেখার আছে’, বলছিলেন মহিধর বাজারের মুদি দোকানদার নুর ইসলাম (৪৮)।

কাপড়ের ফেরিওয়ালা আনোয়ারা বেগম এখন আর সন্তানদের একমুঠো খাবার তুলে দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। কিন্তু এখন চিন্তা করেন তাদের প্রতিষ্ঠিত করা নিয়ে। হাল না ছাড়া এই নারী সন্তানদের প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন এখন।

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

1h ago