আম্পানের আঘাত

‘সকালে আইসা দেখি ঘর বলতে কিছু নাই’

আম্পানের আঘাতে ভেঙে গেছে ঢালচরের অনেক ঘরবাড়ি। ছবি: স্টার

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচর। চারিদিকে নদীবেষ্টিত এই চরের আয়তন ৩১ বর্গ কিলোমিটার। লোক সংখ্যা ১৬ হাজার ৮০০। বারে বারেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই চরটিতে আঘাত হানে। তবুও বহুমানুষ এই চর আঁকড়ে ধরেই পড়ে আছে।

এই চরে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র থাকলেও নেই কোনো আশ্রয়কেন্দ্র। ভোলায় এক হাজার ১০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তবে, ২১টি চরের যে দুইটিতে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই, তার মধ্যে একটি এই ঢালচর।

‘এখানে আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। কিন্তু, মেঘনা নদীর গর্ভে সেটি বিলীন হয়ে গেছে’— দ্য ডেইলি স্টারকে এমনটিই জানিয়েছেন ভোলার জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক। তার মতে, একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই এখানে আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় সময়টুকু পাওয়া যায়নি।

ঢালচরের চারদিকে শুধু নদীর বিস্তার। মেঘনা নদী যেন দুই বাহু দিয়ে আগলে রেখেছে এই চরটিকে। আবার চরটিকে ডুবিয়ে, ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত করার আয়োজনেও সেই মেঘনার ভূমিকা। মেঘনা ছাড়াও রয়েছে তেতুলিয়া নদী। রয়েছে অসংখ্য খালও।

প্রতিবারই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢালচর। ঝড়ের তাণ্ডবে বারবার পরাস্ত হয় এই দ্বীপের অধিবাসীরা। গত ২০ মে রাতে আম্পান এই চরটিকে ছয় ফুট পর্যন্ত প্লাবিত করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখানকার বেশ কিছু মানুষকে ট্রলারে করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেও থেকে যায় অন্তত তিন হাজার মানুষ। এই মানুষগুলো আশ্রয় নেয় পুলিশ ক্যাম্প, চেয়ারম্যানের বাড়ি, স্কুল, এনজিও অফিসে। সেই রাতে ঝড়ে-জলোচ্ছ্বাসে নিজের ঘরবাড়ি হারিয়েছেন সোহাগ গাজী। ঘরে নৌকা, জাল, ছাগল, হাস, মুরগী, ফসল থাকায় তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি।

তিনি বলেন, ‘ঘরে হাস, মুরগী ছাগল রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারি নাই। আশ্রয় নিয়া ছিলাম পরিত্যক্ত পুলিশ ক্যাম্পে। মধ্যরাতে এক বুক সমান পানি উঠে। ক্যাম্প উঁচু জায়গায় থাকায় ২/৩ ফুট পর্যন্ত পানি উঠে। সকালে আইসা দেখি ঘর বলতে কিছু নাই। সঙ্গে জাল, হাস, মুরগী সব ভেসে গেছে। নৌকাটাও অনেক দূরে ডুবে পড়ে ছিল। ঘরে এক ফোটা দানা নেই যে খাব।’

ঘর হারিয়ে ত্রাণের জন্য বসে ছিলেন আবু তাহের। ত্রাণ আসলে তবেই দুমুঠো খেতে পারবেন। ২১ মে সকালে চরফ্যাশন উপজেলার কচ্ছপিয়া আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজ বাড়ি ঢালচরে ফিরেছেন বাচ্চু ফরাজী। নিজের বাড়িঘরের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘এর আগে বুলবুল’র আঘাতেও এই এলাকায় প্রবল ক্ষতি হয়। বহু মানুষের ঘরবাড়ি উড়ে যায়। এবারও তাই হলো। প্রতিবছর ঘর হারালে কী থাকে?’

বিধ্বস্ত ঘরটিকে আবার দাঁড় করাতে ব্যস্ত শাজাহান মিয়া। প্রতিবছরই তার এই সংগ্রাম যেন আরও দীর্ঘ হয়ে ওঠে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার আঘাত হানলেও আবার ঘর বাধে এই জনপদের মানুষ। সাগরের নোনাজল ঠেলে ধরে রূপালি ইলিশসহ আরও বিচিত্র সব মাছ। মাছের একটি অংশ তারা শুঁটকি করে বাজারে বিক্রি করে কিছু আয় করে। আর এভাবেই বাধা ঢালচরের মানুষের জীবন-মৃত্যু।

স্থানীয় মেম্বার মো. মোস্তফা বলেন, ‘প্রতি বছরই ঝড়-বন্যায় এখানে ক্ষয়-ক্ষতি হয়। ঝড়-বন্যা শেষে আবারও আশায় বুক বেঁধে চরের মানুষগুলো ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। আবার অনেকেই হারিয়ে যায় দুর্যোগে।’

ঢালচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম হাওলাদার বলেন, ‘এই চরের অধিকাংশ মানুষ মৎসজীবী। ঝড়ের তাণ্ডবে কম-বেশি সবারই ক্ষতি হয়েছে। তবে, একদম ঘর ভাসিয়ে নিয়েছে অন্তত ১৮ জন জেলের। এ ছাড়াও, শতাধিক জেলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে।’

ভোলার জেলা প্রশাসক মাসুদ আলম সিদ্দিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘একসময়ে এখানের মানুষ বন্যা-ঝড়ে বনে চলে যেতেন বলে শুনেছি। কিন্তু, সেই অবস্থা এখন আর নেই। আমরা চার হাজার নয় শ জনকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছি। এরপরেও কিছু মানুষ রয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে স্কুলভবনসহ বড় ভবনগুলোতে থাকতে বলা হয়েছিল। এখানে নৌবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ত্রাণ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’

বরিশাল বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী জানান, এই চরগুলোতে বন বিভাগের পক্ষ থেকে বনসৃজন করার কথা। কিন্তু, মানুষ মহিষ চরানোর কথা বলে প্রথমে চরে আশ্রয় নেয়। এরপরে বসতি গড়ে তোলে। যে কারণে এসব চরে এখন অসংখ্য মানুষের বাস। এসব চর অঞ্চল নিয়ে উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হবে।

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago