অর্ধবার্ষিক, পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা না হলে খুব কি ক্ষতি হবে?
সময়টা ১৯৮২ সাল, এসএসসি’র টেস্ট চলছে। যেদিন আমার ইকোনমিকস পরীক্ষা, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। এত বৃষ্টি যে সকালে ঘুম ভেঙেই দেখলাম রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। আমি কীভাবে পরীক্ষা দিতে যাব? রাস্তায় কোনো রিকশাও নাই।
আব্বাকে ঘুম থেকে তুলে বললাম, আমি কীভাবে পরীক্ষা দিতে যাবো? তুমি আমাকে নিয়ে চল, যেভাবে পারো। আব্বা বললেন, ‘ধুর যেতে হবেনা। ঘুমিয়ে পড়।’ আমি বললাম, ‘মানে কী আব্বা? আমার পরীক্ষা যদি হয়ে যায়, তখন আমি কী করবো? আমার টেস্ট পরীক্ষা।’ আব্বার যুক্তি ছিল, এই বৃষ্টিতে কীভাবে পরীক্ষা হবে? এ অসম্ভব। তুই আবার ঘুমা। এই কথা বলে আম্মা ও আমার সব হইচইকে পাত্তা না দিয়ে নিজে ঘুমাতে চলে গেলেন।
প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা পর আমি বন্ধুদের ফোন করে জানতে পারলাম ইকোনমিকস পরীক্ষা হয়ে গেছে। আমি মানবিক বিভাগে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, আর আমিই পরীক্ষা দিতে পারলাম না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলাম। সব রাগ গিয়ে পড়লো আব্বার ওপর।
আমার কান্না শুনে আব্বা ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘কিরে মা, কাঁদিস কেন?” আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, ‘আব্বা তুমি পরীক্ষা দিতে নিয়ে গেলে না। আর দেখো আমার পরীক্ষা হয়ে গেছে।’ এই কথা শুনে আব্বা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে রসিকতা করে হেসে উঠে বললেন, ‘ও তাই বল। আমিতো তোর কান্না শুনে মনে করেছিলাম যে আমি মারা গেছি। তাই তুই এত কাঁদছিস।’
তারপরই তিনি বললেন, ‘মা পরীক্ষার জন্য জীবন না। কাজেই এরকম দু-একটা পরীক্ষা দিতে না পারলে কোনো ক্ষতি হয় না। দোষটা তোর স্কুলের। এই খারাপ আবহাওয়াতে পরীক্ষা নেবে কেন?’ পরীক্ষা জরুরি। কিন্তু, জীবনের চেয়ে নয়। সত্যিই তাই আমি সেবছর টেস্ট না দিয়েও এসএসসিতে ইকোনমিক্সে ৭৩ নম্বর পেয়েছিলাম এবং এখন পর্যন্ত জীবন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্রসঙ্গটা মনে পড়ল এই করোনাকালে শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক বা জেএসসি টাইপ পরীক্ষাগুলো নিয়ে। এই পরীক্ষাগুলো না নিলে কী আর এমন ক্ষতি হবে তাদের জীবনে?
এখন সব অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাথায় অন্যতম বড় চিন্তা— করোনার পরে স্কুল খুললে বাচ্চাদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা কি হবে? হলে কবে হবে? সিলেবাস কী হবে? ঘরবন্দি অবস্থায় অনলাইনে পড়াশোনা করা কতটা সম্ভব? আমাদের দুই কোটি শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে। সরকার ভাবছে ফাইনাল পরীক্ষা ফেব্রুয়ারিতে নিয়ে যাবে বা সিলেবাস কমিয়ে দেবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কি আসলে আগস্টে পরীক্ষা দিতে পারবে? তাদের প্রস্তুতি কী? শিক্ষার্থীরা জানেই না যে কী পড়তে হবে তাদের। কারণ, কোনো ঘোষণা ছাড়াই স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকায় বা শহরের বস্তিতে যে শিশুটি পড়ছে, যার স্কুলে গিয়ে শেখা ছাড়া, শেখার আর কোনো উপায় নেই; অথবা এমন শিক্ষার্থী যাদের অভিভাবকরা পড়তে পারেন না কিংবা তাদের পড়াশোনাতে সহায়তাও করতে পারেন না, তাদের অবস্থা খুবই করুণ। দেখলাম ইউনিসেফ সরকারের সঙ্গে মিলে শিশুদের জন্য কার্যকর দূরশিক্ষণ ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে। এই ব্যবস্থায় টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করছে। সেইসঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও সাহায্য করছে কীভাবে দূরশিক্ষণ ক্লাস করানো যাবে। এক্ষেত্রে তারা টিভির ওপর বেশি জোর দিতে চাইছে। কারণ, বাংলাদেশে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ইন্টারনেট অ্যাকসেস নেই বললেই চলে।
এ প্রসঙ্গে ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক সেমিনারে বলেছেন, ‘চর, হাওড় ও চা-বাগানের শিশুদের স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট নেই। দেশের শতকরা ৪৪ ভাগ পরিবারের টেলিভিশনও নেই। তাহলে তারা কেমন করে অনলাইনে ক্লাস করবে?’
তাই আমরা যে উদ্যোগই নেই না কেন, তাতে লক্ষ্য রাখতে হবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যেন অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা যেন বাদ না পড়ে। বিকল্প উপায়ে কী শিক্ষা দেওয়া যায়, তা দেখতে হবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য মাধ্যমিক স্তরের পড়া প্রচার করতে শুরু করেছে সরকারের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের সহায়তায়। যাতে মহামারিকালে শিশুরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এটা একটা সাময়িক সমাধান হতে পারে। কিন্তু, এটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো উপায় নয়। সবচেয়ে বড় কথা এই নিদারুণ অভাবের সময় শিশুদের পক্ষে কি পড়া সম্ভব হচ্ছে?
শিক্ষার্থীদের কাছে পরীক্ষা হচ্ছে ‘একটা চাপ’। আর সেই পরীক্ষা যদি করোনার এই ছুটির পর হুড়োহুড়ি করে নেওয়া হয়, তাহলে সেটা হবে বেশ বড় ধরনের একটা অত্যাচার। তাই আমরা চাইছি পিইসি, জেএসসি ও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা বাতিল করা হোক। সিলেবাস কমিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষার জন্য তৈরি করা হোক। যদিও ধরে নেই শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস করে পড়াশোনার সঙ্গে কিছুটা সংযোগ রাখছে। কিন্তু, এত এলোমেলো পরিস্থিতিতে পড়াশোনা শিখে পরীক্ষা না দিলে কী হয়? এই পরীক্ষাগুলো বন্ধ করলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক— সবাই মুক্ত হবেন বাড়তি চাপ থেকে। পশ্চিম বাংলা ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে তারা প্রি প্রাইমারি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অটো প্রমোশন দিয়ে দেবে।
আমাদের জন্য ভয়াবহ তথ্যটা হচ্ছে— এক তৃতীয়াংশ শিশু ঝরে পড়বে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুধু করোনাকালীন অভাবের কারণে। সানেমের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে শতকরা ৩০ জন শিক্ষার্থী আর বিদ্যালয়ে ফিরে আসবে না। কারণ, তাদের পরিবার কাজ হারাবে এবং সংসারে অভাব বাড়বে। (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)
সেই সেমিনারে শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে প্রযুক্তিগত দুষ্প্রাপ্যতা, প্রান্তিকতা ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে অনলাইন শিক্ষাদান পদ্ধতি সফল হবে না। সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে, কত পরিবার খুব খারাপ অবস্থায় রয়েছে, কাদের প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার নাই, কাদের হাতে টাকা নাই, কারা শিশুদের স্কুলে পাঠানোর বদলে কাজ করতে পাঠাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, আমাদের শিক্ষাবছর কমাতে হবে। ১০ মাস করে হিসাব করলে তিন বছরে এই ছয় মাস সময়টা অতিক্রম করা যাবে। সিলেবাসও কমাতে হবে ১০ ভাগ। সময় নষ্ট কোনো চ্যালেঞ্জ নয়, আসল চ্যালেঞ্জ ঝরে পড়ার হার কমানো। এর পাশাপাশি শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। জিডিপির শতকরা তিন ভাগ করা উচিৎ বরাদ্দ। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় দেশের চাইতে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ সবচেয়ে কম।
এই ক্রান্তিকালে বিবিসির একটা খবরে দেখলাম বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতকরা ৯৮ ভাগ হলেও শিশুরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক বলেছে, প্রাথমিকের ৬৫ ভাগ শিক্ষার্থী বাংলাই পড়তে পারে না। ইংরেজি আর গণিতে অবস্থা এর চেয়েও দুর্বল। এদের অনেকে অক্ষরও চেনে না। শিক্ষকরা মনে করেন, এই বাচ্চাগুলোকে বাসায় পড়ানোর মতো কেউ নেই। এ ছাড়া, শতকরা ৫০ ভাগ শিক্ষকের বছরের পর বছর কোনো প্রশিক্ষণও হয় না। ইউনেস্কো বলেছে, বাংলাদেশে শিক্ষকদের এই ট্রেনিং পাওয়ার হার এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। এই যদি হয় সাধারণ সময়ে শিশুদের শেখার অবস্থা, তাহলে করোনাকালে দূরশিক্ষণের মাধ্যমে তারা কতটা শিখবে আর পরীক্ষাই বা কীভাবে দিতে পারবে?
তবে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে পড়াশোনা করাটা কোনো অসুবিধা না। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী জয়িতা জানাল, অনলাইনে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু, স্কুল আর বাসায় থেকে পড়াটা এক হচ্ছে না। তাই খুব একটা মজাও লাগছে না। তবে, এই অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন শিশু শ্রেণির কিছু অভিভাবক। যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত নন, তারা বেশ বিপাকেই পড়েছেন শিশুকে অনলাইন ক্লাস করাতে গিয়ে। এই মাধ্যমে ইতোমধ্যেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা নিয়েছে বা নেবে। ইংরেজি মাধ্যমে যারা পড়ে, তাদের সবার ইন্টারনেট ব্যবহারে সক্ষমতাও আছে। ফলে অসুবিধা তেমন হয়নি।
সারাবিশ্বেই করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখেছে। সব পরীক্ষা যেমন: জিসিই, জিসিএসই, ক্যামব্রিজের অধীন সব পরীক্ষা, এমনকি জিম্যাট, জিআরই, স্যাট, এসিটি— সব বন্ধ হয়ে আছে। চীন, জাপান, আমেরিকার মতো ফাইভ-জি ব্যবহারকারী দেশগুলো এই পরিবর্তনকে খুব সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছে। তাদের শ্লোগান হচ্ছে— ‘যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকেই পড়াশোনা।’ ক্লাসে বসে পড়ার পাশাপাশি তারা অনলাইন পদ্ধতিকে কাজে লাগাতে চাইছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরনো পরীক্ষার স্টাইল পাল্টে অনলাইন অ্যাসেসমেন্ট পদ্ধতি চালু করেছে।
আমাদের সরকারেরও উচিৎ হবে ই-লার্নিং পদ্ধতির সঙ্গে ক্লাসরুম পদ্ধতিকে সংযুক্ত করা। কীভাবে করবে এটা বড় চ্যালেঞ্জ। সবার কাছ থেকে সহযোগিতা ও ধারণা নিতে হবে। তবে, সবচেয়ে আগে খোলার পরপর অর্ধবার্ষিক ও পিইসি, জেএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার অনুরোধ করছি। পরীক্ষার জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্য হোক পরীক্ষা।
শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments