ইতালিতে নতুন আসা অভিবাসীরা কি বৈধ হওয়ার সুযোগ পাবেন?
দীর্ঘ আট বছর পরে ইতালিতে বসবাসকারী বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ‘কারা এই বৈধতার সুযোগ নিতে পারবে, কী কী শর্তে বৈধতা দেওয়া হবে’— এসব বিষয়ে বিস্তর লেখা গত ২৫ মে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে পাঠকদের মনে উদয় হয়েছে নানা প্রশ্ন। অভিবাসী হতে আগ্রহীরা অসৎ দালালদের কথায় বিভ্রান্ত হচ্ছেন, ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এসব বিষয় থেকে এ লেখায় মূলত দুইটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে।
ক. এখন যারা ইতালিতে যাচ্ছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তারা কি এই বৈধতার সুযোগ পাবেন?
খ. যারা এবার বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন না, তারা কি আগামীতে বৈধ হতে পারবেন, পারলে তা কবে নাগাদ?
বিস্তারিত লেখায় যাওয়ার আগে অন্য প্রসঙ্গে দুটি কথা লিখতে চাই। এখানে প্রাসঙ্গিক না হলেও লেখা দরকার মনে করছি। ভাগ্য বদলাতে চাওয়া মানুষদের বিভ্রান্তি দূর হওয়া দরকার।
লিবিয়ার আদম ব্যবসায়ী চক্র ২৬ জন বাংলাদেশিসহ ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করেছে। ছোট-বড় এমন ঘটনা সেখানে অনেক বছর থেকে হয়ে আসছে। যা অধিকাংশ সময় খবরের আড়ালে থেকে যায়। আমরা জানতেও পারি না। এবারের ঘটনার ভয়াবহতা ও মর্মান্তিক আবেদন অতীতের অনেক হৃদয়ভাঙ্গা খবরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। সবাইকে ব্যাপক নাড়া দিয়েছে। কিন্তু, এর কি কোনো প্রতিকার হবে? বিদেশ যেতে আগ্রহী মানুষ ও
আমাদের সরকার কি সচেতন হবে? দেশের মানুষদের কাছে পর্যাপ্ত ও সঠিক তথ্য কি সরবরাহ করা হবে? দালালদের নিয়ন্ত্রণ করা হবে?
গাদ্দাফি সরকারের পতনের পরে থেকে লিবিয়া ভয়ানক হয়ে উঠে। সেখানের সন্ত্রাসীরা আদম বেচাকেনা শুরু করে। অনেকবার এ বিষয়ে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। কিন্তু, কেউ সচেতন হয়নি, সতর্ক হয়নি।
বিদেশে চাকরি করে নিজের ও পরিবারের ভাগ্য বদল করতে ইচ্ছুক মানুষদের অসৎ আদম ব্যবসায়ীরা ভুল/মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে। তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অল্প টাকায় বা টাকা পরে দেওয়ার কথা বলে দালালরা মানুষ জড় করে। তাদের নানা রকমের স্বপ্ন দেখায়। ইউরোপের নিশ্চিত জীবনে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। বিভিন্ন উপায়ে তাদের বিভ্রান্ত করে মানবেতরভাবে লিবিয়ায় আনা হয়।
লিবিয়ায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাদের রিসিভ করে আদম ব্যবসায়ীদের স্থানীয় দালালরা। তারা নিজেদের আস্তানায় নিয়ে বন্দি করে অভিবাসীদের। নির্যাতন শুরু করে টাকার জন্য। বাধ্য হয়ে অভিবাসীরা দেশে ফোন করে যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করে দিতে বলে।
অভিভাবকরা ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা তুলে দেন সন্তানের জীবন বাঁচাতে। এরপর দালালদের প্রথম গ্রুপ অভিবাসীদের বিক্রি করে দেয় অন্য গ্রুপের কাছে। তারাও একইভাবে দেশের আত্মীয়-স্বজনদের ওপর চাপ দিয়ে অর্থ আদায় করে এবং আরেক পার্টির কাছে বিক্রি করে। এভাবে কয়েক হাতবদল হয়ে এক সময় অভিবাসীদের আধমরা অবস্থায় সাগর পাড়ে জড় করা হয়। ছোট ছোট ট্রলারে ধারণক্ষমতার থেকে অনেকগুণ বেশ অভিবাসী তুলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় অথৈ সাগরে। কিছু দূর গিয়ে ট্রলার চালক ট্রলারের ইঞ্জিন খুলে নিয়ে অন্য ট্রলারে চড়ে ফিরে আসে। অভিবাসীরা ভাসতে থাকে কূল-কিনারাহীন দরিয়ায়। ভাগ্য ভালো হলে ইউরোপীয় কোনো দেশের সাগর পাহারাদারদের নজরে পড়লে প্রাণ নিয়ে ঘাটে উঠতে পারে, অন্যথায় সাগরেই সলিল সমাধি হয়।
লিবিয়ার আদম ব্যবসায়ী চক্র এতটাই ভয়ানক যে তারা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে খুন-জখমে লিপ্ত হয়। অভিবাসী ছিনতাইর ঘটনা ঘটে। এক গ্রুপ ছিনতাই করে নিয়ে যায় অন্য গ্রুপের অভিবাসীদের। শুরু হয় আবার নির্যাতন, আবার হাতবদল, আবার অর্থ আদায়। অনেক সময় গ্রুপগুলোর শক্তি প্রদর্শনের বলি হয় অভিবাসীরা।
এসব নির্যাতনে, পাশবিক অত্যাচারে অনেক অভিবাসীর মৃত্যু হয়। খাবারের অভাবে, তৃষ্ণায়, অক্সিজেন না পেয়েও কেউ কেউ মারা যায়। তাদের খবর হয়তো আমাদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছায় না। কিন্তু, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের কাছে এসব খবর না পৌঁছানোর কোনো কারণ নেই।
লিবিয়ায় যে এমন ঘটনা ঘটছে, ঘটার সম্ভাবনা প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে তা সবাই জানলেও আমাদের রাষ্ট্র জানলো না কেন? সেখানে আমাদের দূতাবাস আছে, তারা অভিবাসীদের জন্য এতদিনে কী পদক্ষেপ নিয়েছে? লিবীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে এর সুষ্ঠু কোনো সমাধান তারা বের করে না কেন? লিবিয়ার ভয়াবহ চিত্র সরকারিভাবে প্রচার করে দেশের মানুষকে সচেতন করা হয় না কেন? কেন দালাল চক্রের দেশি সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় না? কেন লিবিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশি দালালদের নিয়ন্ত্রণ করতে সে দেশের প্রশাসনের সহযোগিতা নেওয়া হয় না? ব্যর্থতা কার, কোথায়? কে নেবে এতগুলো লাশের দায়?
এসব প্রশ্নের উত্তর মেলানো জরুরি। অন্যথায় শুধু হাহুতাশ করা বা শোক প্রকাশ করার মাধ্যমে মূলত নিজেদের ভণ্ডামি প্রকাশ পায়।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। এখন যারা ইতালিতে যাচ্ছেন বা যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তারা কি এই বৈধতার সুযোগ পাবেন?
সঠিক ও সরল উত্তর হলো ‘না’। যারা ২০২০ সালের ৮ মার্চের পরে ইতালিতে প্রবেশে করেছেন বা করবেন, তারা কেউ এবারের আইনে বৈধ হতে পারবেন না। বৈধতার জন্য আবেদন করতে হলে আবেদনকারীকে প্রহণযোগ্য প্রমাণ দেখাতে হবে যে, ৮ মার্চের আগে তিনি ইতালিতে প্রবেশ করেছেন।
সুতরাং যারা দালালের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে, জীবনবাজি রেখে ইতালির পথে ছুটছেন বৈধ হওয়ার আশায়, বিনয়ের সঙ্গে বলি— এই আইনে আপনাদের আশা পূরণ হবে না। বরং আপনারা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতো ভয়াবহ রাস্তায় পা বাড়িয়েছেন, বাড়াচ্ছেন।
কারণ, এবারের পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। করোনা সংকটের কারণে ইতালিসহ শক্তিশালী অর্থনীতির প্রায় সব দেশ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পর্যটন শিল্প অচল হয়ে পড়েছে। এর ফলে দেশে দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়বে। এই পরিস্থিতির মধ্যে মনে হয় না কোনো দেশ নতুন করে অভিবাসী গ্রহণ করবে বা বৈধতা প্রদান করবে।
উল্লেখ্য, ইতালির কৃষিখাত এবং গৃহস্থালির কাজে শ্রমিক সংকট সর্বসাকুল্যে দেড় লাখের কাছাকাছি। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ মতে, ৮ মার্চের আগে ইতালিতে প্রবেশ করা বৈধ কাগজপত্রহীন অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ৮ থেকে ১০ হাজার।
প্রশ্ন উঠেছে, দেড় লাখ শ্রমিক চাহিদার বাইরে অন্য অভিবাসীদের কী হবে? তারা কোন উপায়ে বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করবেন? এসব নিয়ে অভিবাসী পাড়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। রাজধানী রোম ও স্বপ্ননগর ভেনিসসহ কয়েকটি শহরের বিক্ষুব্ধ অভিবাসীরা আগামী ৩১ মে সমাবেশের আহ্বান করেছে।
কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমাবেশ থেকে সব ধরনের বৈধ কাজের বিনিময়ে বৈধতার দাবি জানানো হবে এবং যেসব অভিবাসীরা ছুটিতে দেশে গিয়ে করোনাভাইরাসের কারণে আটকে গেছেন, তাদের ইতালিয় ডকুমেন্টের মেয়াদ বাড়ানোর দাবি তুলে ধরা হবে।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। যারা এবার বৈধতার সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন না, তারা কি আগামীতে বৈধ হতে পারবেন, পারলে তা কবে নাগাদ?
সহজ উত্তর হলো— দীর্ঘ আট বছর পর সরকার এবারের বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আগামী কত বছর পরে আবার এই ধরনের ঘোষণা দেওয়া হবে বা আদৌ দেওয়া হবে কি না, এর কোনো উত্তর নেই, নিশ্চয়তাও নেই।
সুতরাং এখন যারা আসছেন বা আসার চেষ্টা করছেন, তারা বড়জোর রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন (এ ধরনের আশ্রয়ের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০ শতাংশই প্রত্যাখ্যাত হয়)। এবারের আইনে আপনারা বৈধ হতে পারবেন না। কবে নাগাদ পারবেন বা আদৌ পারবেন কি না, তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই।
ভুল সংশোধন: গত ২৫ মে’র লেখায় ভুলক্রমে ছাপা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের আগে যাদের স্টে পারমিট বাতিল হয়েছে, তারা এবারের আইনে নতুন করে স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
সঠিক হলো— ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের পরে যাদের স্টে পারমিট বাতিল হয়েছে, তারা এবারের আইনে নতুন করে স্টে পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারবেন। অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবরের আগে যাদের স্টে পারমিট বাতিল হয়েছে, তারা এই আইনের আওতায় পড়বেন না।
আরও পড়ুন:
Comments