আমাদের যুবশক্তিই একদিন নতুন ভোর এনে দেবে

ফাইল ফটো

ভাষা আন্দোলনে ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, দেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্দুক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষের দ্বারে দ্বারে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছিল, ১৯৮৮ বন্যায় ত্রাণ কাজ পরিচালনা করেছিল, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, ৭১’র যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে দেশজুড়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়েছিল, দেশের বন্যা-খরায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, করোনা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য পাড়ায়-পাড়ায় কাজ করেছে এবং সবশেষে আম্পানের প্রবল ঝড়ে বিধ্বস্ত প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে কারা?— এরা তারাই, যাদেরকে নিয়ে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

হ্যাঁ, কথা বলতে চাইছি আমাদের সেই যুবশক্তিকে নিয়ে। করোনার ভয়ে দেশব্যাপী সবাই যখন আতঙ্কিত তখন অন্যান্য অনেক এলাকার মতো ঠাকুরগাঁও জেলার পাঁচ উপজেলায় তরুণ-তরুণীরা নিজ উদ্যোগে পায়ে হেঁটে প্রায় ২৫ হাজার প্রান্তিক মানুষ যেমন নারী, শিশু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, দলিত ও প্রতিবন্ধীদের কাছে লিফলেট, মাস্ক বিতরণ করেছেন।

সেখানকার ২৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৫০টি বাজারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাজ করেছেন। কর্মহীন মানুষের তালিকা তৈরির কাজে সাহায্য করেছেন। কাজের প্রয়োজনেই দেশের আরও অনেক এলাকা থেকে এরকম সংবাদই পেয়েছি আর অবাক হয়েছি তারুণ্যের শক্তি দেখে।

অথচ আমাদের এখন ভয় এই উৎসাহী যুব শক্তিকে নিয়েই। কারণ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, এই মহামারি বাংলাদেশের কর্ম-উপযোগী যুব সম্প্রদায়ের জন্য একটি বড় ধাক্কা। যুবকদের চাকরির সুয়োগ বহুগুণ হ্রাস পেয়েছে এবং আরও পাবে। যেসব নারীকর্মী কম বেতন পান এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন, তারাই সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন এই সময়।

আইএলও আরও জানিয়েছে দেশের চার ভাগের মধ্যে এক ভাগেরও বেশি অর্থাৎ ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ যুবক কোনো কাজে, শিক্ষায় ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে জড়িত নন। জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বয়স কাজ করার মতো এবং এদের মধ্যে শতকরা ৩ দশমিক ২৪ কোটি শ্রমিকের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর।

আমরা যখন আমাদের এই ব্যাপক সংখ্যক জনশক্তিকে কোনো কাজ দিতে পারবো না তখন এই শক্তি পরিণত হবে আপদে। বেকারত্ব, অভাব আর দারিদ্র তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করবে। যুবকরা কাজ করতে চায়, আয় করতে চায়, জীবনে দাঁড়াতে চায়।

গত কয়েক বছর যাবৎ যুব সম্প্রদায় শুধু চাকরি নয়, নানা ধরণের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এদেশের যুবকদের নতুন শ্লোগান ছিল ‘চাকরি করবো না, চাকরি দিবো’। কিন্তু, এখন এই মহামারি ছেলেমেয়েগুলোকে স্থবির করে দেবে।

তাই সরকারের উচিৎ হবে এদের জন্য প্রণোদনা খাত রাখা। যেখান থেকে ঋণ নিয়ে তারা আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, করোনার কারণে প্রায় ৮৭ লাখ তরুণ-তরুণী দারিদ্রতার শিকার হবে। যুবকদের এই দারিদ্র তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি, আয় ও পারিবারিক সহিংসতার ওপর প্রভাব ফেলবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ছাত্রছাত্রীদের জীবনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে। দেশে এমনিতেই দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ হয় খুব কম। সেখানে পুরো প্রক্রিয়াই এখন বন্ধ হয়ে আছে। যেমন, বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন অনেক তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল জাপানে কেয়ার গিভার হিসেবে যাওয়ার জন্য। তাদের একটা বড় ব্যাচ ট্রেনিং শেষ করে বসে আছে। অন্যরা ট্রেনিং নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। পুরো প্রক্রিয়াটাই স্থবির হয়ে আছে করোনার কারণে। এখন সরকার যদি এগিয়ে এসে জাপান সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় আসে তাহলেই এই প্রকল্প আবার চালু হবে।

এরকম আরও উদ্যোগ বন্ধ হয়ে আছে। আমাদের অনেক অভিবাসী শ্রমিক করোনার ধাক্কায় দেশে ফিরে এসেছেন। প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী শ্রমিকের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ ও যুবক। এদেরকে কিছু একটা প্রণোদনা বা ঋণ দিয়ে কোনো কাজ বা ব্যবসার সুযোগ করে দিতে হবে সরকার ও ব্যাংকগুলোকে। নতুবা এতগুলো শ্রম-উপযুক্ত মানুষ ও তাদের পরিবার পানিতে পড়বে।

সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে অনেক তৈরি পোশাক কারখানা। প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছে। এখানে যারা কাজ করেন, তাদের সিংহভাগ নারী ও যুব সম্প্রদায়ের। কাজ না থাকায় কী হবে এদের অবস্থা।

আইএলও’র মতে যুব সম্প্রদায় এই মহামারিকালে ভারসাম্যহীনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই মহামারি তিনভাবে যুব সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রথমত, তাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, তাদের পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বন্ধ। এবং তৃতীয়ত, যারা কাজে ঢুকতে চাচ্ছেন তারা পারছেন না।

যে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হবেন, তাদের হতাশা সবচেয়ে বেশি হবে। এরা অনেকেই খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন। চোখে স্বপ্ন একটা ভালো চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু, এখন শোনা যাচ্ছে যারা এই বছর, আগামী বছর এবং এর পরেও পাশ করে বের হবে, তাদের জন্য চাকরি পাওয়া খুব কঠিন হবে। এদের অনেকে কাজই পাবে না অথবা কম টাকার কাজ পাবে।

কাজ না পাওয়া থেকে যে হতাশা তৈরি হবে তা এই তরুণ-তরুণীদের সৃজনশীলতা, কর্ম উদ্যোগ, ভালো কিছু করার ইচ্ছা, সমাজের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা, প্রতিভা, সততা সব নষ্ট করে দেবে। হতাশা থেকেই যুব শক্তি হয়ে যেতে পারে পথচ্যুত ও মাদকাসক্ত।

সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো: যখন আমাদের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে ভালো করেছে এবং গড় প্রবৃদ্ধি ছিল সাত শতাংশ, তখনো কিন্তু আমাদের চাকরির বাজার উজ্জ্বল ছিল না। বিশেষজ্ঞরা একে বলেন ‘চাকরি বিহীন প্রবৃদ্ধি’। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় চাকরির সুয়োগ ছিল কম।

আমাদের দেশের অনেক যুবক কাজ করেন সফটওয়্যার কোম্পানিতে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী অধিকাংশ সফটওয়্যার কোম্পানির ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ চলমান কাজের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। বিলও বন্ধ হয়ে আছে। বছর শেষে ১ থেকে ১ দশমিক ৩  বিলিয়ন ডলার আয়ের সুযোগ নষ্ট হবে। পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো যুব শক্তি।

পাশাপশি, গত ১০/১৫ বছর ধরে ট্যুরিজম ও এভিয়েশন ব্যবসা শুরু করেছিল এই যুবকরাই। খুব ভালো লাভ হচ্ছিল। প্রচুর ছেলেমেয়ে এখানে কাজও করছিল। কিন্তু, এখন সব বন্ধ। কবে, কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কেউ জানে না।

আমরা যদি যুবশক্তির অবস্থার উন্নয়নে কোনো উল্লেখযোগ্য ও দ্রুত উদ্যোগ না নিই, তাহলে এই ভাইরাসের দায় আমাদের দশক ধরে বয়ে বেড়াতে হবে। যদি তাদের বুদ্ধিমত্তা ও শক্তিকে সুযোগের অভাবে বা দক্ষতার কারণে ব্যবহার করতে না পারি, তাহলে তা আমাদের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেবে। সেই সঙ্গে করোনাপরবর্তী অর্থনীতিকে দাঁড় করানোও অনেক কঠিন হয়ে যাবে। বলেছেন আইএলওর মহাপরিচালক গে রাইডার।

তাহলে এই যুব সম্প্রদায়কে কাজের পরিবেশের মধ্যে রাখার জন্য, হতাশা থেকে মুক্তির জন্য কী করতে পারি? ধনী দেশগুলো ট্রিলিয়ন ডলার প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের দেশের পক্ষে এতোটা করা সম্ভব না হলেও কিছু উদ্যোগ নিতেই হবে। সরকারের প্রণোদনা ভাতার মধ্যে যুবকদের কথা আলাদা করে বা প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ করা দরকার।

এখন আমাদের উচিৎ হবে যুবকদের সহায়তা দেওয়ার মতো জরুরি, বড় মাপের এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া। জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ নিয়ে এগুতে হবে শ্রমিক ও ছোট উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।

যুবকদের কাজের সুযোগ, শ্রম বাজার, বেকারত্ব, অভিবাসী শ্রমিক, নারী শ্রমিক, কর্মঘণ্টা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, পেশাগত ও স্বাস্থ্য  নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভাবতে হবে সরকার ও বড় উদ্যোক্তাদের।

সানেম ও একশন এইড বাংলাদেশের ‘ইয়ুথ পারসপেকটিভ অন কভিড-১৯ ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ: রেসপন্স থ্রু ন্যাশনাল বাজেট অ্যান্ড প্ল্যানিং’ বিষয়ক গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে যে যুব সম্প্রদায়কে স্বাস্থ্য সুবিধা, শিক্ষা সুবিধা, সামাজিক প্রতিরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে। এর পাশাপাশি যুবকদের ঋণ মওকুফ করতে হবে, সুদবিহীন ঋণ দিতে হবে এবং বেশি বেশি করে কাজে নিয়োগ দিতে হবে।

ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, দেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ২০১৯-২০ এর শতকরা ৫৭ ভাগ যুব উন্নয়ন ঘনিষ্ঠ নয়। মহামারির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে দুই বছর মেয়াদি কর্মসূচি নিতে হবে। অথবা ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রথম দুই বছর এই রিফর্মের কথা ভাবা যেতে পারে।

দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প আছে। বিশ্বব্যাংক ইতোমধ্যে সাতটি শিল্পখাতে টাকা দেওয়ার কথা ভেবেছে। এসব কারখানায় মধ্যমমানের দক্ষ লোক লাগবে। কাজেই প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে যুবকদের কাজে লাগাতে হবে। সরকার একটা চাকরি তহবিল চালু করতে পারে। যেখান থেকে তারা মালিকদের টাকা দিয়ে সহায়তা করবে, এই চুক্তিতে যে, উদ্যোক্তারা যেন তরুণ-তরুণীদের কাজ দেয়। সুবিধা বঞ্চিত তরুণ-তরুণীর কথা বেশি করে ভাবতে হবে।

আমাদের যুব সম্প্রদায়কে বিশ্বাস রাখতে হবে নিজেদের ক্ষমতার ওপর। কারণ বিশ্বাসই পারে জীবনে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি যোগাতে। ভয় হচ্ছে মিথ্যা এবং জীবনই সত্য। মানব সভ্যতা অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও টিকে যায়। কারণ অনেক মানুষ আছেন যারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। যারা ভাবেন এই আঁধার একদিন কেটে যাবে এবং নতুন ভোর আসবে।

শাহানা হুদা রঞ্জনা, সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago