প্রয়োজন কর্মসংস্থান ও চাহিদা সৃষ্টির বাজেট

শোনা যাচ্ছে এবারের বাজেট হবে ভিন্ন, চিরাচরিত অবস্থা থেকে বের হয়ে নতুন ধারায়। স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পরিবহন ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান করা হবে। তবে বাজেটে অবশ্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি চাহিদা সৃষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।
farmer
রয়টার্স ফাইল ফটো

শোনা যাচ্ছে এবারের বাজেট হবে ভিন্ন, চিরাচরিত অবস্থা থেকে বের হয়ে নতুন ধারায়। স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পরিবহন ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান করা হবে। তবে বাজেটে অবশ্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি চাহিদা সৃষ্টির বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।

অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে যাতে ‘ইউ’ প্যাটার্ন না হয়ে ‘ভি’ প্যাটার্ন হয় সে অনুযায়ী বাজেট হতে হবে। কর্মসংস্থান ও চাহিদা বৃদ্ধির জন্য খরচ করতে হবে, তা না হলে ‘ইউ’ প্যাটার্ন দীর্ঘমেয়াদী হবে।

অর্থনীতিতে ‘ডাচ ডিজিজ’ বলে একটি ধারনা আছে। ‘ডাচ ডিজিজ’ হলো যখন কোন দেশের অর্থনীতি একটি খাতের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়। আমাদের অর্থনীতিতে তার লক্ষণ দৃশ্যমান। যাকে আমরা ‘কোয়াজি-ডাচ ডিজিজ’ বলতে পারি।

আমাদের অর্থনীতি মূলত দুটি ভিত্তির ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছিল। একটি হলো, পোশাক রপ্তানি ও অন্যটি হল প্রবাসী আয়। দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে পোশাক রপ্তানি থেকে যা ব্যাপক অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছে— কমছে রপ্তানি আয়।

অন্যদিকে, প্রবাসী আয়ও কমছে। গত মে মাসে ২০১৯ সালের মে মাসের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম এসেছে প্রবাসী আয়। তেলের দাম মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মসংস্থান কমবে ও আমাদের অনেক শ্রমিক দেশে ফিরে আসবে।

বিজিএমই’র সভাপতির বক্তব্য মতে, জুন মাসের শেষে যদি শ্রমিক ছাঁটাই করা হয় তাহলে তাদের রক্ষার শেষ আশ্রয়স্থল হবে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি। এ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ লোক বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে। বিদেশফেরত এসব লোক ভিড় করবে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে। ফলে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়বে।

দেশে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকপ্রধান কৃষি সে ভার নিতে পারবে কিনা, যদি না কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। পোশাক রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বহুমুখিকরণ করা গেলে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ঠ অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে খরচ করতে পারলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মানুষ গ্রামমুখি হবে, শহর কেন্দ্রিকতা কমবে, সংক্রমণও কমবে।

স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও পরিবহন ব্যবস্থায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি তার গুণগত খরচ করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ পর্যন্ত অসংক্রামিত রোগ যেমন ক্যান্সার ও এইডসের চিকিৎসা দিতে পারেনি। করোনা যেভাবে নিজেকে পরিবর্তন করছে তাতে তা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি যদি অনির্মূলযোগ্য হয় তাহলে এ নিয়েই আমাদের ‘নিউ নরমাল‘ অবস্থায় বাঁচতে হবে।

প্রয়োজন হবে মাস্ক, স্যানিটাইজার, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন ইত্যাদির পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো। স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়ন ব্যবস্থার ঈঙ্গিত বাজেটে থাকতে হবে।

কেবলমাত্র বরাদ্দ বাড়িয়েই কোনো খাতের পরিবর্তন সম্ভব নয়, যদি না সে বরাদ্দের গুণগত ব্যবহার করা হয়। অতীতে দেখা যায়, বরাদ্দ যাই থাকুক না কেনো তার পুরোপরি খরচ করা যায় না। বছর শেষে ‘জুন মাসে খরচের ব্যাপক তাড়া’— এ প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সতের কোটি লোকের ‘ইমিউনিটি’ বাড়ানো ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার। এই খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ একদিকে উৎপাদন বাড়াবে ও অন্যদিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ কমাবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হবে তা অনেকটাই নিশ্চিত।

রপ্তানিকারক দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা, বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তনসহ দেশে দেশে জাতীয়তাবাদ চাড়া দিয়ে উঠলে আমদানি নির্ভর দেশগুলো বড় ঝুঁকিতে পড়বে। বাংলাদেশ শুধু কৃষিপণ্যের আমদানির জন্য বাৎসরিক ব্যয় করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকা।

২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে খাদ্য পণ্যের দামের ‘বাবল’-এর কারণে ভারত বাংলাদেশে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছিল। সে বিষয়টি নীতি নির্ধারকদের মনে থাকার কথা। অর্থনীতির তুলনামূলক সুবিধাতত্ত্ব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। রাতারাতি এটা সম্ভব হবে না, তবে দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার মাধ্যমে তা করা যেতে পারে।

কৃষিকে বাণিজ্যকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে কৃষিতে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কৃষির বিভিন্ন উপখাতকে দক্ষ ও প্রতিযোগী করে তুলতে হবে। কৃষিতে এসএমই ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। তরুণ উদ্যোক্তাদের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডমুখি করার জন্য ফাইনান্সিয়াল ইনক্লুশান নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতিকে নতুন রূপে সাজানো সম্ভব। তার মাধ্যমে ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিত নির্বাচন ইশতেহারে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়ন করা যাবে।

বিবিএস এর তথ্যানুযায়ী দেশে পুকুরের আকার ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ১২৭ একর, স্থায়ী পতিত জমি ১ কোটি ৬৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩৭ একর ও স্থায়ী পতিত জমি ৯ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার ২৩৭ একর। বিনিয়োগ ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে এই জমিগুলোকে উৎপাদনে নিয়ে আসতে পারলে কৃষি উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

দেশে পুকুরের পরিমাণ ৫ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার একর। প্রয়োজনীয় খনন ও মেরামত করে পুকুরগুলোকে মাছ চাষের পাশাপাশি পুকুরপাড়ে সবজির চাষ করা যেতে পারে। তার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও ভিডিও মারফত প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা বাজেটে থাকতে পারে।

দেশে প্রচুর সংখ্যক ডোবা, নালা, খাল ও মরা নদী আছে। এগুলো সংস্কার করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাসহ পাড়ে সবজি চাষ সম্ভব। বৃষ্টির পানি সঞ্চয় করে কৃষি জমিতে সেচ হিসেবে ব্যবহার ও অন্যদিকে মাছ চাষের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে অনেক চরাঞ্চল আছে যেখানে মিষ্টি কুমড়া, সূর্যমুখি ইত্যাদির চাষ বাড়ানো যেতে পারে।

দেশের গড় শস্য নিবিড়তা ২০১৮ সালের হিসাব মতে ১৯৮। তার অর্থ হলে মোট আবাদকৃত জমিতে ফসল ফলানো হয় গড়ে ২ এর চেয়ে কম সংখ্যক। এক ফসলি জমি চাষযোগ্য জমির তিন ভাগের একভাগ। বর্তমানে এক ফসলি জমির পরিমাণ ৫০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৬ হাজার একর। এই বিপুল পরিমাণ জমিকে কেনো দুই বা তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা যায়নি বা কীভাবে করা যায় তার জন্য গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও তার ব্যবহার নিশ্চিত পারলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।

করোনা মহামারির এ সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সরকারের রাজস্ব আদায়। দেশের আমদানি ও রপ্তানির প্রভাবে শুল্কের পরিমাণ কমবে। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যও কমবে। ফলে মূসক আদায় হবে কম। আয়কর কমবে কারণ কর্মসংস্থান কমার কারণে অনেকের আয়কর সীমার নিচে চলে যাবে। আয় কম হলে ব্যয় হবে কীভাবে?

সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে এবার এর সুযোগ কম। সরকার আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। তবে করোনা যেহেতু একটি বৈশ্বিক সমস্যা, আক্রান্ত দেশগুলোও দাতা সংস্থার কাছে ঋণ চাইবে। ফলে এক ধরণের প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে।

সেক্ষেত্রে সরকারের নীতি নির্ধারকদের কূটনৈতিক পর্যায়ে শক্ত ও কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে যাতে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া যায়। কম প্রয়োজনীয় খাতে খরচ কমিয়ে অগ্রাধিকার খাতে খরচ করতে হবে।

লেখক:

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগ ও পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব এগ্রিবিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। ইমেইল: [email protected]

প্রফেসর ড. ইসমত আরা বেগম, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। ইমেইল: [email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।) 

Comments