আজও ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে বন বিভাগ
আজ ১৪ জুন। গত ১৯৯৭ সালের এই দিনে ভোররাত ১টায় মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া গ্যাসকূপে যুক্তরাষ্ট্রের তেল গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টালের ড্রিলিং চলাকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বন, পরিবেশ, রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও বন ও পরিবেশের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপুরণ পায়নি বলে দ্য ডেইলি স্টারকে জনিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ কারণে বিস্ফোরণের চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছে বন বিভাগ।
সূত্র জানায়, লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের ভেতরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালের দায়িত্ব পায় অক্সিডেন্টাল। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ দেয় জার্মান কোম্পানি ডিউটেক’কে।
গ্যাস ফিল্ডের ১৪ নম্বর ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপ খননকালে বিস্ফোরণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের পরিবেশের জীববৈচিত্র্য, রেল ও সড়কপথ, ফুলবাড়ি চা বাগান, খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর ও পান জুম, পিডিবির ৩৩ হাজার বিদ্যূৎ লাইনের। পরোক্ষভাবে ২৮টি চা বাগানসহ ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।
এছাড়াও, ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়। এর বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। দূর্ঘটনায় সৃষ্ট দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাগুরছড়া ঘেঁষা লাউয়াছড়া বন। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এই বনে শত বছর ধরে বৃক্ষ লতাগুল্ম এবং মায়ামৃগ, ভাল্লুক, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমা পড়া বানর, চিতাবাঘ, মথুরা, বনমোরগ, ধানেশ, অজগর, দাঁড়াস, কেউটে, সুতানলী, ব্যাঙ গিরকিট, তক্ষক, পেঁচা আর নাম না জানা হাজারো প্রাণীর একটি বৃহৎ অংশ।
দূর্ঘটনার দুই বছরের মধ্যে ফুলবাড়ি চা-বাগানের ক্ষতিগ্রস্ত টি প্ল্যান্টেশন এলাকার ক্ষতিপূরণ ও খাসিয়া পুঞ্জির ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ২ কোটি ৫ লাখ টাকা দাবির মধ্যে ৪০ লাখ টাকা ও বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়।
২০০৮ সালে মাগুরছড়া ও লাউয়াছড়ায় শেভরন ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্নকালে আবার বিভিন্ন এলাকার ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ফলে লতা, গুল্ম, বহু উদ্ভিদ এবং বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ ও ছোট প্রাণী হারিয়ে যাওয়ায় এখনও বড় বড় প্রাণীগুলোকে খাবার সংকটে ভুগতে হচ্ছে।
বন বিভাগের হিসাব মতে, প্রত্যক্ষ ক্ষতি ৩২ কোটি ৫৩ লাখ এবং অন্যান্য ক্ষতি মিলিয়ে মোট ১৭৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এই সময়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় পুরো হিসাব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০৯ কোটি টাকা নিরূপণ করে অক্সিডেন্টালের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি জানায়।
দূর্ঘটনার সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার পর কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করেছিল।
তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।
খাসি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রচার সম্পাদক সাজু মারজিয়াং দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তা বুঝতে পারছি।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাগুরছড়া দূর্ঘটনায় শুধু পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। ১৯৯৯ সালের আগস্টে অক্সিডেন্টাল মাগুরছড়া গ্যাসকূপসহ তাদের ব্যবসা ইউনিকলের কাছে হস্তান্তর করে। ইউনিকল দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্ষতিপূরণ বিষয়ে টালবাহানা শুরু হয়।
মৌলভীবাজার পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নূরুল মোহাইমীন মিল্টন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির দেওয়া রিপোর্টে জানা যায়, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্টের ৮৭ দশমিক ৫০ একর এলাকা গ্যাসের আগুনে ক্ষতি হয়। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ দশমিক ৫০ একর এলাকা। ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটি টাকা।’
‘একইভাবে ৪১ দশমিক ৫০ একরের ২২ দশমিক ৮২৫ ঘনফুট গাছ-গাছালিরও আংশিক ক্ষতি ধরা হয়। সব মিলিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্যাস, ক্ষতিগ্রস্থ বন ও পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি আদায়ে মার্কিন কোম্পানির টাল বাহানায় মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ২৩ বছরে তিনটি কোম্পানির হাত বদল ঘটলেও পুরো ক্ষতিপূরণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ আজও গৃহীত হয়নি,’ যোগ করেন তিনি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি। এ দূর্ঘটনায় ২ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপুরণ দাবি করে মামলা বন বিভাগ। কিন্তু, আজও কোনো দাবি আদায় হয়নি।’
‘বন ও পরিবেশের এই ক্ষতিপূরণ আদায় হওয়া আমাদের দাবি,’ যোগ করেন তিনি।
Comments