শাবাশ বাংলাদেশ
কিছুদিন আগের কথা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরে প্রচারিত একটা বিজ্ঞপ্তি শুনেছিলাম। এই ঘোষণাগুলোর বিশেষ মজা হচ্ছে— বিজ্ঞপ্তি প্রচারে ব্যবহৃত যানটি চলতি পথেই প্রচারণা চালাতে থাকে। ফলে কেউ ইচ্ছা করলেই সম্পূর্ণ বিজ্ঞপ্তি শুনতে পারবে না। কিছুটা শুনতে হবে এবং কিছুটা অনুমান করে নিতে হয়। সেদিনের জেলা প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিটা হুবহু না হলেও এমনটাই ছিল— ‘আজ জেলায় ১৯ জন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এদের বেশিরভাগই শহরে। তাই আপনি বাজারে কেনাকাটা করবেন, না বাড়িতে থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত আপনার।’
জেলা প্রশাসন করোনার প্রকোপ ঠেকাতে প্রতিনিয়ত নানামুখী নির্দেশনা দিচ্ছে। সরকারও কিছু নির্দেশনা দিয়ে দোকান-পাট, অফিস-আদালত সীমিত পরিসরে খুলে দিয়েছে। সাধারণ ছুটির পর চলছে ১৫ দিনের পর্যবেক্ষণকাল। গার্মেন্টস, কলকারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এমন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসন ঘোষিত আদেশে মানুষ কীভাবে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে?
দেশে দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজেদের দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের চরম উৎকর্ষতা প্রকাশের জন্য করোনাভাইরাসের মারাত্মক বিপদ থেকে দেশবাসীকে উদ্ধারে কতটা আন্তরিক, তা বিশ্ববাসীসহ সাধারণ মানুষকে বোঝাতে একটার পর একটা নির্দেশ দিয়েই চলেছে। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, বাড়িতে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি মানা— এমন রকমারি আদেশ-নির্দেশ-আবেদনে দেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত। সরকারি ক্ষমতাবানদের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতাবানসহ ব্যক্তি উদ্যোগেও সাধারণ মানুষকে সতর্ক করতে দেখা যাচ্ছে।
এর মাঝে গার্মেন্টস মালিকরা অনেক আগেই নিজেদের ক্ষমতাবলে কারখানা খুলে দিয়েছে। তেমনি জেলা প্রশাসনও ইতোপূর্বে দোকান খোলার স্মারকলিপি গ্রহণ করে তা খোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এখন চলছে সীমিত পরিসরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা মোতাবেক কার্যক্রম। লকডাউনের লিখিত নির্দেশ আছে, যা দায়িত্ববানদের কাজের যথার্থতা প্রমাণের দলিল হিসেবে স্বীকৃত। ফলে এখন যা চলছে তার দায় স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ জনগণের। কিছু মানুষতো সাধারণ জনগণকে অসভ্য বলতে পিছপা হয়নি। সত্যি কি জনগণকে অসভ্য বলার ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে? বোধ করি তোষামোদে অন্ধ হলে মানুষ সব পারে।
করোনা সতর্কতা নিয়ে ভাবতে বসে অনেকদিন আগে টেলিভিশনে দেখা একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায়। পরিষ্কার মনে না থাকলেও একজন উপস্থাপক অনুষ্ঠান চলাকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার কাছে দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে চাইলেন। ওপাশ থেকে জানানো হয়— বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই, রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকবে। অথচ বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, যা একপর্যায়ে টেলিফোনে কর্মকর্তাকে শোনানো হয়।
আমাদের ক্ষমতাবান-দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রাথমিকভাবে করোনাকে আমলেই না নিয়ে জনগণকে এরূপ পূর্বাভাসযুক্ত বাণী দিয়েছেন। কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ না করে হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা বিপদের গভীরতা অনুভূত হওয়ার পর বাণীর চরিত্র কিছুটা পরিবর্তন হলেও ব্যবসা বন্ধ করেননি। বরং জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের আন্তরিকতা প্রকাশ করেছেন। আর আবহাওয়া অফিসের মতো গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতিটা আগাম সপ্তাহকে বিপজ্জনক ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। একই কথা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি ভুলে করোনাকালীন প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষমতাবানদের বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করে বীরদর্পে এগিয়ে চলেছেন আর অসভ্য হিসেবে খ্যাত হচ্ছেন!
সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখার জন্য ন্যূনতম যা করণীয় ছিল, তা হয়েছে আংশিকভাবে। সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমের সমন্বয়হীনতা পরিবেশকে কঠিন করে তুলেছে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে দলে দলে ঘরের বাইরে আসতে বাধ্য হয়েছে। অনেক স্থানে ত্রাণের জন্য মানুষ বিক্ষোভও করেছে। চুরির মহোৎসবে সরকার থেকে একপর্যায়ে ১০ টাকা কেজি দরের চাল বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাত ২টার দিকে স্ত্রীকে নিয়ে ত্রাণ দেওয়া বা সাইকেল চালিয়ে ত্রাণ মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার খবরও কমতে শুরু করে। একপর্যায়ে সরকার দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ত্রাণ কমিটি করা হলেও এই পরীক্ষার ফল খুব একটা সুখকর হলো না। সেখানেও স্বজনপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, দলপ্রীতি একাকার হয়ে গিয়েছে। দুর্ভাগ্য, রাজার অংশ হিসেবে যারা দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেন, তারা সময়ের বাস্তবতায়ও নিজেদের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন করলেন না।
প্রধানমন্ত্রী ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে প্রণোদনা প্রদানের অভিপ্রায় ঘোষণা করে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রয়োজনের তুলনায় যা ছিল নগণ্য। অর্থনৈতিক সামর্থ্যের কথা বললেও তা বুঝে আনা কঠিন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই গার্মেন্টস মালিকদের পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দেন। অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই প্রণোদনা দেশের করোনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণহীন করতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। প্রণোদনা পাবার পরও বেতন-বোনাসের জন্য ঈদের আগে শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন, এখনো অনেক গার্মেন্টস শ্রমিক বেতনের দাবিতে রাজপথে ধরনা দিয়ে চলেছেন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আতঙ্কে বিক্ষোভ। অথচ দায়িত্ববানরা নির্বিকার থেকে গার্মেন্টস মালিকদের কর্মকাণ্ডে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন।
অতীতের শিক্ষা এমনটাই যে প্রাপ্তির সীমারেখা টানা এই মালিকদের জন্য খুব কঠিন। আবার এর বিপরীত চিত্রটাও দেশের মানুষকে আশান্বিত করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা নিজেদের মূলধন ভেঙে তাদের কর্মচারীদের রক্ষা করেছেন, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ব্যবসায়ীরা জানেন তারা দিনে দিনে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছেন। তারপরও তারা সবাইকে নিয়ে বাঁচার সংগ্রাম করে চলেছেন। বিশ্বাস করি, সরকার বিষয়টা অনুধাবন করেই সীমিত পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু, প্রণোদোনাপ্রাপ্তদের কারণে তা সফল হলো না।
এখন জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে আবার নতুন করে লকডাউন কঠোর করার উদ্যোগ চলছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা দ্বিতীয়বার লকডাউনের আওতায় আসছে। প্রশ্ন একটাই— প্রশাসনের ব্যর্থতার দায় কেন জনগণ নেবে? দেশের মাত্র কয়েকজন গার্মেন্টস মালিককে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। আর ৫০ লাখ পরিবার অর্থাৎ দুই কোটি মানুষকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা। গার্মেন্টসকে দেওয়া টাকা যদি দুই কোটি পরিবারকে দেওয়া হতো, তাহলে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষকে নিরাপত্তার আওতায় আনা সম্ভব হতো। এতে করে এই মানুষগুলোর ঘরে খাদ্য থাকতো। তাতে করে তাদের বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে কমে যাওয়ার কারণে সরকারের লকডাউন কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখত।
বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চাইতে আমরা করোনাভাইরাসের বিপদ থেকে ভালো আছি বলে অনেক দায়িত্ববান নিশ্চিন্ত আছেন। এই সব দায়িত্ববানরা ইচ্ছা করলে করোনামুক্তিতেও আমাদের বিশ্বের ‘রোল মডেল’ করে দিতে পারেন। ১৬ কোটি মানুষের দেশে এখন পর্যন্ত (১৪ জুন) পাঁচ লাখ এক হাজার ৪৬৫ জন মানুষের করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজারের মতো পরীক্ষা করা হচ্ছে। এখনো সব জেলা সদরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি। এখন আমাদের দায়িত্ববানরা প্রতিদিন শুধুমাত্র দুই থেকে পাঁচ শ রোগী শনাক্ত কমাতে শুরু করলে অচিরেই করোনা রোগীর সংখ্যা শূন্যে নেমে আসবে। এতে করে দেশকে করোনামুক্ত বলে বিশ্বে প্রচার করা যাবে। বিনা পরীক্ষায় এখন যারা মারা যাচ্ছে, আগামীতে তারা মারা গেলে কেউ করোনা আক্রান্ত প্রমাণ করতে পারবে না।
বাঙালি অদম্য সাহসে ১৯৭১ সালে লাঠি আর মরিচের গুঁড়া নিয়ে সেনানিবাস ঘেরাও করে রেখেছিল। সেই বাঙালিকে করোনাভাইরাস ভয় দেখাবে, তা কীভাবে সহ্য করা যায়? তাই বাঙালি বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে আজ ঘরের বাইরে। শুধু খাবার জন্য নয়, নিজেদের বিলাসী ইচ্ছা পূরণের জন্যও ছুটে বেড়াচ্ছেন। ঈদের পূর্বে পছন্দের ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে বাচ্চা নিয়ে নারীদের মিছিল মনে করিয়ে দেয়— নশ্বর পৃথিবীতে আগামী দিনগুলো পাও কি না পাও, তাই আজই জীবনকে উপভোগ করে যাও। জীবন উপভোগে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনার প্রয়োজন নেই।
স্বাধীন বাঙালি স্বাধীনভাবেই নিজের জীবন এগিয়ে নিয়ে যাবে। অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সামনে লাঠি আর মরিচের গুঁড়া আজও বাঙালির সাহস। স্বাধিকার প্রমত্ত বাঙালির জয় হোক। শাবাশ বাঙালি। শাবাশ বাংলাদেশ।
এম আর খায়রুল উমাম, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments