এমপি শহিদের জালিয়াতির জবানবন্দি দিয়ে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরলেন ১১ শ্রমিক

alim and sohag
ছবি: সংগৃহীত

দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এক দল বাংলাদেশি কুয়েত এসেছিলেন বছর দুয়েক আগে। সবটুকু সম্বল বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে তারা এসেছিলেন।

তাদের কেউ কেউ ঋণ করেছিলেন আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে। কেউ আবার বিক্রি করেছিলেন পিতৃপুরুষের বসতভিটা। সে সব টাকা তারা দিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুরের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলামের মালিকানাধীন আদম ব্যবসার প্রতিষ্ঠানকে। বিদেশভুঁইয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন ছিল তাদের।

কিন্তু, কুয়েত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরপরই তাদের সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। তারা জানতে পারেন, বাংলাদেশে যে টাকার বেতনের কথা বলা হয়েছিল তা তারা পাবেন না।

এছাড়াও, তাদেরকে প্রতিদিন অনেক ঘণ্টা অতিরিক্ত শ্রম দিতে হবে। আর কোনো সুযোগ ছিল না বলেই তারা আপত্তি না জানানোর সিদ্ধান্ত নেন।

কিন্তু, তাদের যন্ত্রণা এখানেই শেষ হয় না। কয়েক মাস পর তারা চাকরি হারান। এরপর, বেঁচে থাকার জন্যে আরও অনেক কম টাকা কাজ করতে শুরু করেন।

তাদের অনেকেই সেই বিমানবন্দরে দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। বছর দুয়েক আগে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে বিমানবন্দরে তারা নেমেছিলেন সেখানেই কাজ করে ভাগ্য বদলানোর চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু, করোনা মহামারির কারণে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধে হয়ে যায়। আবারও কর্মহীন হয়ে পড়েন তারা।

এমন পরিস্থিতিতে নিয়োগকর্তারা তাদেরকে মরুভূমির এক জায়গায় নিয়ে আসেন যেখানে কাজী পাপুল নামে পরিচিত এমপি শহিদকে মানব ও অর্থপাচারের অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করে কুয়েতের সিআইডি।

কুয়েত পুলিশ আরও ১২ বাংলাদেশিকে আটক করে। পরে, তাদেরকে এমপি শহিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়। তাদেরকে ক্ষতিপূরণ ও দেশে ফেরত পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

তারা পুলিশকে সহায়তা করে এবং পুলিশ তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠায়।

তারা প্রায় খালি হাতেই দেশে ফেরেন।

গতকাল মঙ্গলবার কুয়েতফেরত এমন চার জনের সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলে জানতে পেরেছে কীভাবে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছিলেন।

ডেইলি স্টারকে তারা বলেন, কুয়েত কর্তৃপক্ষ তাদেরকে পুরো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু, ফ্লাইটে ওঠার আগে তাদের হাতে ধরিয়ে দেয় মাত্র দেড়শ কুয়েতি দিনার (১ কুয়েতি দিনারে ২৭৬ বাংলাদেশি টাকা)। তা নিয়েই তারা গতকাল সকালে ঢাকায় আসেন।

আব্দুল আলিম সেই ভাগ্যবিড়ম্বিতদের একজন।

৪৩ বছর বয়সী আলিমের বাড়ি নওগাঁয়। ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায় শহিদের এজেন্সিকে তিনি সাড়ে ৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন বলে জানান।

দুই সন্তানের জনক আলিম টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কর্মভিসা ছিল। বলা হয়েছিল, আমার আট ঘণ্টার শিফট হবে। মাসে দেওয়া হবে ১৪০ দিনার।’

আরও বলেন, ‘যখন সেখানে যাই। গিয়ে দেখি প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টার শিফট। বেতন মাসে ১০০ কুয়েতি দিনার। আমার প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরে আমাকে দিনমজুর হিসেবে পাঠিয়েছিল।’

তার অভিযোগ, সেখানে শহিদের লোকদের প্রতিদিন আট দিনার দিয়ে তিনি খুচরা কাজ করার অনুমতি পেয়েছিলেন। আমান ও মাহবুব নামের দুই জন তার কাছ থেকে সেই টাকা নিত।

করোনার কারণে লকডাউন শুরু হলে তাকে কুয়েতের আব্বাসিদ এলাকায় তার প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন একটি ভবনে নিয়ে আসা হয় বলে জানান আলিম। কয়েকদিন পর তাকে মরুভূমিতে সেই প্রতিষ্ঠানের অধীন একটি ক্যাম্পে পাঠানো হয়।

আলিম বলেন, ‘একদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে কুয়েতের সিআইডি পুলিশ সেই ক্যাম্পে অভিযান চালায় এবং আমাদের সিআইডি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানে আরও ১১ জনকে দেখি। সেখানে আমাদের পাঁচ-ছয়দিন রাখা হয়।’

সিআইডি ভবনে শহিদ ও তার সহযোগী রাশেদকে দেখতে পান উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সিআইডি কর্মকর্তারা আমাদের জানান যে আমাদের কোম্পনি অবৈধ। তাই আমাদের কুয়েতে থাকাটাও অবৈধ।’

‘সিআইডি অফিসে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আমরা শহিদকে কতো টাকা দিয়েছি। আমরা তাদেরকে সব বলি। তারপর তারা বলেন, আমরা যে টাকা খরচ করেছি তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং আমাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে,’ যোগ করেন শহিদ।

‘কিন্তু, হঠাৎ ১২ জনকে তারা সোমবার রাতে বিমানবন্দরে নিয়ে আসে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘বিামানবন্দরে একজন সিআইডি ও কোম্পানির কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। তারা আমাদের সবাইকে দেড় শ দিনার ধরিয়ে দিয়ে বলেন বাকিটা পরে দেওয়া হবে।’

শহিদের শাস্তি দাবি করে আলিম আক্ষেপ করে বলেন, তার সব শেষ হয়ে গেছে। তিনি যথাযথ ক্ষতিপূরণেরও দাবি জানান।

একই ঘটনা শাহ আলমের ভাগ্যেও।

ময়মনসিংহের মল্লিকবাড়ি এলাকার এই বাসিন্দার বয়স ২৯ বছর। একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মভিসা নিয়ে তিনি কুয়েত গিয়েছিলেন। তিনিও দিয়েছিলেন সাড়ে ৭ লাখ টাকা।

আলমকেও পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে কর্মভিসা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তারও মাসে বেতন হবে দেড় শ দিনার।

‘কিন্তু, আমি চাকরি পাই নাই। কোম্পানি আমাদের জন্যে দুই মাসের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তারপর আমাকে বিমানবন্দরে পাঠানো হয়,’ বলেন আলম।

‘আমি সেখানে মুঠের কাজ পাই। বিমানবন্দরে কাজ পাওয়ার জন্যে শহিদের লোকদের প্রতিদিন ১০ দিনার দিতে হতো,’ যোগ করেন তিনি।

তার অভিযোগ, সিআইডি কর্মকর্তা ও শহিদের লোকদের মধ্যে যোগসূত্র আছে। ‘তারা সবাই আমাদের বোকা বানিয়েছে। আমরা সব হারিয়েছি,’ মন্তব্য আলমের।

কুয়েতফেরতদের আরেকজন মোহাম্মদ সোহাগ মিয়াও শোনালেন একই কাহিনি।

গত রোববার কুয়েতের আল রাই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, কুয়েত সরকারের মধ্যে এমন কেউ আছেন যারা এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাদের সহযোগিতায় টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা কুয়েতে আসতে পেরেছে।

‘মারাফি কুয়েতিয়া’ নামের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির যৌথ মালিক শহিদ ও কুয়েতের এক নাগরিক।

কুয়েতে নেওয়ার জন্যে সেই ব্যক্তি বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ৩ হাজার দিনার পর্যন্ত নিয়ে থাকেন।

কুয়েতে অবস্থান করার জন্যে শ্রমিকরা সেই প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর বিশাল অংকের টাকা দিয়ে থাকেন বলেও সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগের দায়েরের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কুয়েতে মানবপাচার ও বিভিন্ন দেশে অর্থপাচারের মাধ্যমে শহিদের ১৪ শ কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করে।

সে মাসেই কুয়েতের গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে যে তিন বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। ১২ ফেব্রুয়ারি অ্যারাব টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই তিন জনের একজন ‘বাংলাদেশের সংসদ সদস্য’।

প্রতিবেদন মতে, সেই তিন জন তিনটি বড় প্রতিষ্ঠানে ‘গুরুত্বপূর্ণ পদে’ আছেন। এসব প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৩৯১ কোটির বেশি টাকার বিনিময়ে ২০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিককে কুয়েতে এনেছে।

আরও পড়ুন:

কুয়েতের সরকারি ২ কর্মকর্তাকে ২১ লাখ দিনার দেন এমপি শহিদ

মানব পাচারের অভিযোগে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কুয়েতে গ্রেপ্তার

লক্ষ্মীপুরের এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা: কাদের

এমপি পাপুলের পদ থাকবে?

গালফ নিউজে বাংলাদেশের এমপির গ্রেপ্তারের সংবাদ

Comments

The Daily Star  | English

BGMEA wants 3-month window from India to clear pending shipments

The association urges the interim government to send a letter to India seeking the opportunity

35m ago