করোনাভাইরাস ও বাস্তব অভিজ্ঞতা

প্রতীকী ছবি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকেই কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয় আতঙ্ক। যদিও এই ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে।

নিজেকে ও পরিবারকে প্রস্তুত করছিলাম আসন্ন বিপদ মোকাবিলার জন্য। গত ২৩ মার্চ থেকে আমাদের বাসা থেকে অফিস শুরু হয়। গত ১৯ মার্চ আমাদের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৩ মার্চ থেকে বাসা থেকে অফিস করার নীতি কার্যকর করার নির্দেশ দেন। আমাদেরকে একটি সম্পূর্ণ নীতিমালা দেওয়া হয়। জীবনকে নতুনভাবে সাজানো শুরু করি। ২৩ মার্চ সকাল ১০টায় ইলেক্ট্রনিক অ্যাটেনডেন্স দিয়ে শুরু হয় ভার্চ্যুয়াল অফিস।

ইতালি, স্পেনসহ সমগ্র ইউরোপজুড়ে শুরু হয় মহামারির বাস্তবরূপ। মৃত্যুর মিছিল, প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা এবং সুস্থতার গ্রাফ অনুসরণ করছিলাম। চাকরির সুবাদে আমার সহকর্মী সমগ্র পৃথিবীব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে লাগল। বিশেষ করে মৃত্যুপুরী হলো আমার স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম ভালোলাগার শহর নিউইয়র্ক।

চাকরির সুবাদে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক শহর ভ্রমণ করেছি। কিন্তু, আত্মার সম্পর্ক হয়েছে নিউইয়র্কের সঙ্গে। বিশেষ করে আমার দ্বিতীয় সন্তান নিউইয়র্কে জন্ম নেওয়ার পর থেকে। ঢাকার পরে নিউইয়র্ক আমার স্ত্রী, সন্তানদের প্রিয় শহর। আজ আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা এবং ভালোলাগার শহর নিউইয়র্ক একইসঙ্গে অদৃশ্য ভাইরাস করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে।

এরই মাঝে আসল ঈদুল ফিতর (২৫ মে)। বাচ্চাদের নতুন পোশাক বিহীন, আনন্দহীন অন্যরকম এক ঈদ। সারাদিন বাসাতেই কাটালাম। স্ত্রী তার অসুস্থ বাবাকে (সদ্য বাইপাস সার্জারি হয়েছে) দেখতে চায়। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের বাসা বসুন্ধরা থেকে গুলশান-২'র দিকে চললাম রাত ১০টার দিকে। অধিক সতর্কতাস্বরূপ গাড়িচালককে নেইনি। রাত ১টায় বসুন্ধরায় ফিরে আসলাম। বাচ্চারা গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফ্রেশ হয়ে ঘুমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ জ্বর অনুভূত হচ্ছিল। মেপে দেখি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নাপা এক্সটেন্ডেড খেয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। ঘুম ভালো হলো না। ২৬ মে সকালে ফোনে ইউনাইটেড হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। সকাল থেকে পাতলা পায়খানাও শুরু হয়েছে। সকাল ১১টার দিকে কথা বললাম কলেজবন্ধু ডা. আবিরের সঙ্গে। দুই চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন প্রায় একই। আবির লক্ষণ শুনে করোনা সন্দেহ করল এবং মোবাইলে সংক্ষিপ্ত বার্তার মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন পাঠাল। নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছি। বাসার মধ্যে হাঁটাহাঁটি ও হালকা ব্যায়াম করছি।

জ্বর ৫-৬ ঘণ্টা পর যায়, আবার ফিরে আসে। আমার বয়স ৪০ বছর। চার বছর যাবত ডায়াবেটিক আছে।

২৬ মে সকাল থেকেই আমার স্ত্রী দুই ছেলেকে আলাদা করে দিলেন। আমার বড় ছেলের বয়স ১০ বছর ৪ মাস, ছোট ছেলের বয়স ৪ বছর ৩ মাস। আমার বড় ছেলে তার ছোট ভাইয়ের পুরো দায়িত্ব বুঝে নিলো। এতে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি। কারণ, আমার স্ত্রী ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের স্বাবলম্বী হতে শেখাচ্ছে। বাসার রাঁধুনিকে স্বাস্থ্যবিধি, পরিচ্ছন্নতা, গ্লাভস-মাস্ক ব্যবহারের গুরুত্ব এবং সঠিকভাবে মেনে চলার সব নিয়ম কানুন আমার স্ত্রী সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। বাচ্চারা কীভাবে তাদের খাবার খাবে, বাথরুম কীভাবে ব্যবহার করবে, ২৪ ঘণ্টা সুন্দরভাবে অতিবাহিত করবে, তার সম্পূর্ণ দিকনির্দেশনা দিলেন। বাচ্চাদেরকে ঘুমাতে হবে রাত ১০টার মধ্যে। কঠোর নিয়ম মানতে হবে। ছোট ছেলে ঘুমানোর সময় খুব কান্না করত আমাদের কাছে আসার জন্য। বড় ছেলে গল্প বলে, বুঝিয়ে (তুমি কাছে না গেলে আল্লাহ মা-বাবাকে দ্রুত সুস্থ করে দেবেন) অনেক কষ্টে ঘুম পাড়াত।

২৮ মে যোগাযোগ করি হোম সার্ভিসের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য। সিরিয়াল পাই ৭ জুন। ইতোমধ্যে খবর পাই ইউনাইটেড হাসপাতাল ফ্লু ইউনিট চালু করেছে। বাইরের রোগীরা পরীক্ষা করাতে পারবে। ২৮ মে রাতে ইয়ং প্রেসিডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ওয়াইপিও) একটা ওয়েবিনারে (ওয়েব সেমিনার) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। আমি শুনছিলাম, কিন্তু, শারীরিকভাবে প্রচণ্ড দুর্বল বোধ করছিলাম। রাতে আমাদের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া আপার সঙ্গে আমার শারীরিক অবস্থা শেয়ার করি। সাহস ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন। আমার স্ত্রীকে একটা চিকেন স্যুপের রেসিপি দিলেন। আমি প্রতিদিন খেয়েছি এবং এটা সত্যিই তাৎক্ষণিক বুস্ট আপে  ভালো কাজ করে।

২৯ মে সকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যার ফোন দিলেন। স্যারের ভরাট কণ্ঠ বরাবরই আমার ভরসা ও অনুপ্রেরণার উৎস। ৩১ মে সকালে চলে যাই করোনা পরীক্ষা করাতে। নমুনা দিতে সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। ২ জুন হাতে পরীক্ষার ফলাফল পাই। করোনা পজিটিভ। আমার স্ত্রী অবশ্য আগের রাতেই পরিচিত চিকিৎসকের মাধ্যমে ফল জেনেছিল। আমাকে বলেছিল, 'ধরে নাও পজিটিভ। আমরা মোকাবিলা করব ইনশাআল্লাহ।' স্যারকে জানালাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের সহযোগিতার কথা বললেন, ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দিলেন।

ইতোমধ্যে আমার স্ত্রী গাড়িচালককে দিয়ে পালস অক্সিমিটারসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস কিনিয়ে এনেছেন। স্ত্রীকে বললাম, 'তুমি আইসোলেশনে যাবেনা?' তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত, আমার সঙ্গেই থাকবেন।

নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছি। দিনে তিন থেকে চার বার গরম পানিতে আদা, কালোজিরা, রসুন, পুদিনাপাতা, লেবু, হলুদ ইত্যাদি মিশিয়ে ভাপ নিচ্ছি। গ্রিন টির সঙ্গে আদাকুচি, কালোজিরা, লেবুর রস মিশিয়ে দিনে চার থেকে পাঁচ বার করে খাচ্ছি।

২ জুন সারারাত ঘুম হলো না। জ্বর ১০২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাথার চুল অনেক বড় হয়েছিল। স্ত্রী সারারাত আমার সেবা করত, সুন্দর ভবিষ্যতের গল্প শোনাত। ঘুম পাড়ানোর যত কৌশল আছে, সব করত। ভোরবেলা ঘুমালাম ৪-৫ ঘণ্টা। শরীর প্রচণ্ড দুর্বল।

৩ জুন স্ত্রী আমার চুল কেটে দিলো। সেই রাতে ঘুম হলো। স্ত্রীর জ্বর, প্রচণ্ড শরীর ব্যথা ও বমি শুরু হলো। চিকিৎসকের পরামর্শে একই ওষুধ শুরু করলাম। ৪ জুন থেকে আমার জ্বর কমা শুরু হলো। শুরু হলো অতিরিক্ত ঘাম ঝরা। ৬ জুনের পর আর জ্বর আসেনি।

৮ জুন রাতে করোনায় মারা যান আমার বন্ধু সহকারী কর কমিশনার শুধাংসু কুমার সাহা। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। সারারাত ঘুম হলো না। আমার পাতলা পায়খানা ছিল ১০ জুন পর্যন্ত। বাসার মধ্যে মাস্ক পরে হাঁটতে থাকি, শক্তি ফিরে পেতে শুরু করি। নিয়মিত খাবারের পাশাপাশি মাল্টা, কাঁচা আম, মৌসুমি ফল, চিকেন স্যুপ খেতে থাকি।

স্ত্রীর সুস্থতার লক্ষণ সুস্পষ্ট। দুই জনের ঘুম বেড়ে গেল। রুচি ফিরে পেতে শুরু করলাম ১১ জুন থেকে। শরীরে শক্তি পাচ্ছি বেশ ভালো। বাসার মধ্য মাস্ক পরে হাঁটা বাড়িয়ে দিলাম। দিনে অন্তত ৪৫ মিনিট। যখন খুব দুর্বল ছিলাম, তখনও হাঁটতাম। স্ত্রী চাইত যেন অবশ্যই কিছুটা সময় হাঁটি।

১৫ জুন ডাক্তার বন্ধুকে সব বলার পর সন্তানদের স্পর্শ করার সবুজ সংকেত পেলাম। বন্ধু বললো, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গেছে। বহু প্রতীক্ষার পর সন্তানদের বুকে জড়িয়ে আদর করলাম। ছোট ছেলে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, 'বাবা তুমি ভালো হয়ে গিয়েছ? আমরা একসঙ্গে ঘুমাব?' উত্তর দিতে পারিনি। বুঝতে পারলাম চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুঝলাম সুখের কান্নাতেও বুকে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়!

আমার স্ত্রীর একটাই লক্ষ্য ছিল— যাতে হাসপাতালে যেতে না হয়। আমার অক্সিজেন লেভেল কখনই ৯৪ এর নিচে নামেনি! ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। আমার চার বছরের পুরনো ডায়াবেটিকের জন্য গত এক বছর কোনো ওষুধ খাইনি। কিন্তু, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খেয়েছি।

অসুস্থতার সময় প্রতিদিন সকাল-বিকাল আমাদের খবর নিয়েছেন আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় স্যার ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নির্বাহী পরিচালক লামিয়া আপা ও আমার বড় ভাই।

ঢাকা কলেজের ফেসবুক গ্রুপে বন্ধুর সংখ্যা এক হাজার তিন শর বেশি! বন্ধুদের দোয়া ও নিখাঁদ ভালোবাসা বেঁচে থাকার শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের বন্ধুদের শুভ কামনা আর ভালোবাসা ভুলবার নয়। সহকর্মীদের দোয়া আর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছি। অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের দোয়া ও আন্তরিকতা সারাজীবন মনে থাকবে। সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজারো শুকরিয়া। এখন নিজেকে প্রস্তুত করছি প্লাজমা দেওয়ার জন্য।

তানবীরুল ইসলাম, ইউনূস সেন্টারের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমন্বয়কারী

Comments

The Daily Star  | English

JP central office vandalised, set ablaze

A group of unidentified people set fire to the central office of Jatiyo Party in Dhaka's Kakrail area this evening

1h ago