বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল আইন এবং খবরের ভেতরের অংশ

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাকে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পর পর তিনটি মামলা হয়েছে। আসামিদের দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং একজন শিক্ষার্থী।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাকে নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পর পর তিনটি মামলা হয়েছে। আসামিদের দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং একজন শিক্ষার্থী।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দুটি মামলার বাদী সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। একটি মামলার বাদী একজন আইনজীবী।

সিরাজাম মুনিরা নামে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের যে শিক্ষককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক, যিনি সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন। শুধু গ্রেপ্তার নয়, তাকে সাময়িক বহিষ্কারও করা হয়েছে। ফলে শেষ পর্যন্ত সেই শিক্ষকের চাকরি থাকবে কিনা, সেটি নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

একই অভিযোগে আরেকটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানকে। তিনি নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক।

মাহির চৌধুরী নামে যে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তিনি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।

ফেসবুকে সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পর্কে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা এবং গ্রেপ্তার নতুন কোনো সংবাদ নয়। কিন্তু রংপুর, রাজশাহী ও সিলেটের সাম্প্রতিক এই মামলাগুলোর বিষয়ে গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ বেরিয়েছে, তার ভেতরের অংশগুলো বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

বেরোবির শিক্ষক সিরাজাম মুনিরার বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি তুষার কিবরিয়া। কিন্তু, পরে একই অভিযোগে মামলা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, যার বাদী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কর্নেল (অব.) আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

গণমাধ্যমকে তুষার কিবরিয়া বলেন, ‘আমার দায়ের করা মামলায় সিরাজাম মুনিরাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু, গ্রেপ্তারের ৩০ মিনিট পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লোকজন এসে প্রশাসনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর চেষ্টা করে।’

দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ নেতার চেয়েও এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উৎসাহ বেশি। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের মত প্রকাশের কারণে (সেই মতামতটি যতই অগ্রহণযোগ্য হোক) তার বিরুদ্ধে মামলা হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব নৈতিকভাবে তার পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু দেখা গেল, পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, উল্টো ছাত্রলীগ নেতার করা মামলার বদলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা মামলায় ওই শিক্ষককে যাতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, তার চেষ্টা চললো। এই হচ্ছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নৈতিক অবস্থান।

শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলার প্রসঙ্গে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদও গণমাধ্যমকে বেরোবির শিক্ষক সিরাজাম মুনিরার বিরুদ্ধে মামলার উদাহরণ টেনে বলেছেন, ‘আপনারা দেখেছেন যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার কী রকম জঘন্য স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং তাকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রী বা যারা শ্রদ্ধাভাজন— তাদের যদি কেউ মানহানি করে, তো এর জন্য দেশের প্রচলিত আইনই যথেষ্ট’।

উপাচার্যর মতে, মো. নাসিম সম্পর্কে ফেসবুকে আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তাই একজন শিক্ষার্থীর এই কাজের দায় বিশ্ববিদ্যালয় নেবে না।

প্রশ্ন হলো, একজন নেতা সম্পর্কে মন্তব্য করায় বা স্ট্যাটাস দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানহানী হয় কী করে?

এটা ঠিক যে, বেরোবির শিক্ষক একজন প্রয়াত নেতার সম্পর্কে যা লিখেছেন, সেটি কোনোভাবেই শালীন নয় এবং একজন শিক্ষকের ভাষা এতো নিম্নরুচির হতে পারে না। সেই শিক্ষক ক্যাম্পাসে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন। স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদল-ছাত্রলীগের চেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করা শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা একটু উঁচুতে থাকে। মনে করা হয়, ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। তারা দেশ নিয়ে ভাবেন। দেশের স্বার্থে রাস্তায় স্লোগান দেন। তারা ছাত্রদল-ছাত্রলীগের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক ও সংবেদনশীল হন।

কিন্তু, সেই শিক্ষক একজন সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী সম্পর্কে যা লিখেছেন, যে ভাষায় লিখেছেন, সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ধরনের ভাষা একজন শিক্ষক ক্লাসরুমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনকি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও ব্যবহার করতে পারেন না। যদি কেউ করেন সেটি তার নিজের দীনতা।

এর অর্থ এই নয় যে, তার বিরুদ্ধে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি ‘বিতর্কিত’ আইনে মামলা করবে এবং পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করবে।

তাছাড়া ফেসবুকে পোস্টটি দেওয়ার কিছু সময় পরে তিনি সেটি মুছে দেন এবং ক্ষমা চান (যেহেতু তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে দিয়েছেন, তাই সেটি এখানে উল্লেখ করা হলো না)। লিখে মুছে দিয়েছেন মানে হলো, হয় লেখার পরে তার মনে হয়েছে এটি ঠিক হয়নি, অথবা তিনি তার কোনো শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে মুছে দিয়েছেন।

সুতরাং আপ করার কিছু সময় পরে যে পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে, সেটি নিয়ে মামলা করার কোন যৌক্তিকতা থাকে না। তারপরও কেন মামলাটি হলো, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, স্ট্যাটাসটি অল্প সময় ফেসবুকে থাকলেও তা খুব দ্রুত ভাইরাল হয় অথবা তার প্রতিপক্ষের লোকজন এটিকে ভাইরাল করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়। পরে মামলাও করে।

ওই শিক্ষক ফেসবুকে প্রয়াত নেতা মো. নাসিম সম্পর্কে যে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেটির জবাব নিশ্চয়ই তিনি ফেসবুকে পেতেন। নিশ্চয়ই তার সহকর্মী এমনকী শিক্ষার্থীরাও এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করতেন এবং দেখা যেতো যে লজ্জিত হয়ে তিনি স্ট্যাটাসটি মুছে দিতেন। হয়তো সেটিই হয়েছে। অর্থাৎ যেহেতু তিনি স্ট্যাটাসটি ডিলিট করে দিয়েছেন, তার মানে তিনি লজ্জিত হয়েছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জন্য এটিও বিরাট শাস্তি।

তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া, তাকে গ্রেপ্তার করা— এসব অতি উৎসাহ এবং এই ঘটনায় শুধু একজন ব্যক্তি বা শুধু একজন শিক্ষকই ছোট হচ্ছেন না, বরং পুরো রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে তাদের একজন সহকর্মীকে ‘সাইজ’ করার মিশনে নেমেছে, তাতে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দল ও বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এসব অভ্যন্তরীণ ব্যাপার দেশবাসীর না জানলেও চলতো।

একটি সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, গত ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮০টি মামলা হয়েছে যার মধ্যে ৩৫টি মামলা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় কমপক্ষে ১৩ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া অন্যদের মধ্যে আছেন পোশাক শ্রমিক চার জন, আইনজীবী দুই জন, দুই জন লেখক ও কার্টুনিস্ট।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমনই জাদুকরী যে, এই আইনে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার হলে জামিন নেই। ইন্টারনেটে প্রকাশিত কোনো সংবাদ বা ফেসবুকে কারো কোনো বক্তব্য পছন্দ না হলেই যে কোনো নাগরিক যে কারোর বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারেন। অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার আসামিরা ধরা না পড়লেও এই আইনে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে।

এই আইনের এমনই গতি যে, একজন আইনজীবী জানালেন, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুম মুনিরার মামলার কাগজ হাতে পাওয়ার আগেই জেলে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তার অজুহাতে এরকম প্রভাবশালী আইন পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কিনা সন্দেহ।

পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পাঠ্যবই মুখস্ত করানোর জায়গা নয়। স্কুল-কলেজের সঙ্গে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো হয়; সহনশীলতার চর্চা শেখানো হয়। একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন কিছু লিখেও থাকেন, যা কোনো একজন সম্মানিত মানুষকে অসম্মানিত করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ও নীতিমালার আলোকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি ভয়াবহ আইনে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না। যদি করে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানটি আর বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Women MPs in reserved seats: How empowered are they really?

Fifty-two years ago, a provision was included in the constitution to reserve seats for women in parliament for a greater representation of women in the legislative body.

8h ago