‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’

প্রাক্তন। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র যা মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শ্যামলী’ কাব্যের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার ওপর ভিত্তি করে এই ছবির কাহিনী দাঁড় করানো হয়েছে।
Digital security act
প্রতীকী ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

প্রাক্তন। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র যা মুক্তি পায় ২০১৬ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শ্যামলী’ কাব্যের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার ওপর ভিত্তি করে এই ছবির কাহিনী দাঁড় করানো হয়েছে।

আরও স্পষ্ট করে বললে ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন’— এই লাইন দুটোর ওপরেই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে চলচ্চিত্রের কাহিনী।

এই ছবি নিয়ে নারীবাদীদের সমালোচনা থাকতে পারে। কারণ ছবিতে নারীর আত্মত্যাগ এবং তাদের সর্বংসহা মনোভাবই পারে সংসারের সুখে আনতে এবং সংসার টিকিয়ে রাখতে— এমন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

সে প্রসঙ্গে যাব না। এই চলচ্চিত্রের একটা গান নিয়ে আলোচনা করতে চাই। হালের খুব জনপ্রিয় সুরকার, গীতিকার এবং গায়ক অনুপম রায়ের ‘তুমি যাকে ভালোবাসো/ স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো/ তার জীবনে ঝড়...’ এই গানটি চলচ্চিত্রের টাইটেল সং ও গানটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

ছবি মুক্তির চার বছর পর এই গানটি নিয়ে কথা বলছি, কারণ, এই গানের একটা অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করার কারণে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জি কে সাদিকে।

গানের কয়েকটা লাইনগুলো ছিল— ‘...তোমার নৌকোর মুখোমুখি/ আমার সৈন্যদল/ বাঁচার লড়াই/ আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে একটা চালের ভুল/ কোথায় দাঁড়াই…’

এই গানের অংশটা যখন দেখানো হয় তখন ভিডিওতে নায়ক-নায়িকার মধ্যে দাবা খেলা দেখানো হয়েছে। সুতরাং, এই অংশটা নিতান্তই রূপক অর্থে ব্যবহৃত।

আজকের পরিস্থিতিতে গানের কোনো অংশের সঙ্গে কিছু মিলিয়ে দেখাটা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক, যদিও লাইনগুলোতে নৌকার কথা আছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। আমি আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর নির্বাচনী প্রচরণা অনেক কাভার করেছি। প্রায়ই তাকে নৌকায় ভোট চেয়ে বলতে শুনেছি— ‘এই নৌকা নূহ (আ.) নবীর নৌকা, বঙ্গবন্ধুর নৌকা’।

আজকের নীতিনির্ধারকদের কাছে বিনীত অনুরোধ গানের এই রূপক অর্থের নৌকার সঙ্গে আপনাদের দলীয় প্রতীককে মিলাবেন না। সেটা মিলালে বরং ছোট করা হবে বঙ্গবন্ধুর নৌকাকে, মুক্তিযুদ্ধের নৌকাকে।

আর যদি মিলাতেই হয়, তবে তো অনুপম রায়কে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলতে হবে। কারণ, তার এই গানে আরও দুটো লাইন আছে... ‘আমার দরজায় খিল দিয়েছি/ আমার দারুণ জ্বর…’।

গানের লাইন দুটো কি বর্তমান করোনাকালের আইসোলেশনকেই বোঝাচ্ছে না? নিশ্চয়ই অনুপম নিজেও স্বীকার করবেন এটা নিছকই কাকতালীয়।

অবশ্য জিকে সাদিক তার ফেসবুকে প্রয়াত আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে ও বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও সমালোচনা করেছে।

তার স্ট্যাটাস নিয়ে আলোচনা না করি। তবে যারা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ তারা সবাই অসুস্থ হলেই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এটা সরকারি হাসপাতালের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর এক ধরনের অনাস্থা নয় কি?

নাসিম ভাইকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য কিংবা সমালোচনা করার কারণে ইতোমধ্যে দুই জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায়। এর মধ্যে একজন শিক্ষক নিজে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

একজন সদ্যপ্রায়ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে নিয়ে কিছু বলতে হলে তার ভাষাও শালীন হওয়া উচিত বলে মনে করি।

কিন্তু, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে? সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ, শিক্ষক কেউ বাদ যাচ্ছে না এই মামলা থেকে।

এই আইনের যখন ড্রাফট হয় বা পরে যখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়, তখন অনেক শ্রেণিপেশার মানুষ এর প্রতিবাদ করেছিলেন। সম্পাদক পরিষদ মাঠে নেমেছিল এর প্রতিবাদে।

তখন বারবার সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আমি নিজেও কাভার করেছি কয়েকটি বৈঠক। প্রত্যেক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন বিতর্কিত ধারাগুলো বাতিল এবং এই আইনের অপপ্রয়োগ না হওয়ার ব্যাপারে। আর সাংবাদিকরা এর যথেচ্ছ ব্যবহারের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বারবার।

মন্ত্রীর আশ্বাস আশ্বাসেই রয়ে গেছে। সাংবাদিকদের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, আমলা— সবাই এখন মামলা করছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে।

এই আইনের অধীনে গত বছর মামলা হয়েছে ৭৩২টি। এর আসামি সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১৭৫ জন। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয়েছে ১৬৫টি এবং এর বিপরীতে আসামির সংখ্যা ৩৩৯ জন।

রাষ্ট্রের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করছে পাবলিক সার্ভেন্ট! মালিক বললাম কারণ সংবিধানের ৭-এর ১ ধারায় স্পষ্টতই বলা হয়েছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।

নাগরিক তার নিজস্ব মতামত প্রকাশ করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খড়গ নেমে আসছে সেটা সংবিধানের ৩৯ ধারারও সুনিদিষ্ট লঙ্ঘন।

৩৯ নম্বর ধারাতে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

রাষ্ট্র ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে বা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়নের প্রয়োজন আছে। তবে সেই আইনের অপব্যবহার বা অতিব্যবহার যাতে না হয় সেটাও রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন।

প্রণয়নের পর থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি অনেকাংশে নাগরিক অধিকারের পথ রুদ্ধ করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না?

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী যখন জীবন উৎসর্গ করেছে দেশের স্বাধীনতার জন্য, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটা ভাবিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেটা প্রতিষ্ঠিত হবে অহিংসার ওপর, সত্যের ওপর ও শ্রেয়ের ওপর।

এই মনোভাব থেকে তিনি লেখেন ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটক (১৯০৯)। সেই নাটকে তিনি ধনঞ্জয় বৈরাগী নামে একটা চরিত্র সৃষ্টি করেন, যিনি ছিলেন অহিংসের প্রতিমূর্তি এবং তার মুখ দিয়ে বলালেন— রাজ্য রাজার একার নয়, অর্ধেক প্রজার।

আগে থেকে ১২১ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা করে সেখানে প্রজার সার্বভৌম অধিকার ঘোষণা করেন। পরের বছরই ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ এই গানের মাধ্যমে তার মনোভাব আবারও প্রকাশ করেন।

রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি সনিবন্ধ অনুরোধ— জনগণকে ভালোবাসুন, তাদেরকে সম্মান করুন, তাদের মতামত, চাহিদাকে গুরুত্ব দিন; তারা ঠিকই সেই সম্মান, সেই মর্যাদা আপনাদেরকেই ফিরিয়ে দেবে।

অন্তত কবিগুরুর এই গানের কথায় ‘রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’ তাই-ই বলা হয়েছে।

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য, চিফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments