ভারতে পাচার হওয়া আসমার ফিরে আসার গল্প

কক্সবাজার জেলার দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার আলীফকির ডেইল গ্রামের ১৭ বছরের কিশোরী আসমা খাতুন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চাকরির খোঁজে বাড়ি ছেড়ে পাড়ি জমান চট্টগ্রাম শহরে। সেখানে নিজ এলাকার কয়েকজন পূর্বপরিচিত মানুষের মাধ্যমে তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরিও মিলে যায়।
কর্মক্ষেত্র থেকেই জিয়াউর রহমান নামের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্যতা গড়ে ওঠে আসমার। যে পরিচয় বড় স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে তাকে। ওই যুবকও তাকে মোটা অঙ্কের বেতনসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা ও বিলাসী জীবনের প্রলোভন দেখায়। ফলে, ওই চাকরির পাঁচ মাস পরেই গত বছরের জুলাইয়ে সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে অবৈধ পথে ভারতে পাচার হয়ে যায় আসমাসহ দুই কিশোরী।
ওই দালাল চক্র তাদের ভারতের একটি স্থানে রেখে প্রত্যেক কিশোরীকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে নারী ব্যবসায়ী ও পাচারকারি চক্রের হাতে তুলে দেয়। ভারতের দালাল চক্রটি বাংলাদেশের কিশোরীদের গুজরাটের আহমেদাবাদ এলাকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রেনে ওঠায়। ওই ট্রেনের বগিতে এক যাত্রী ছিলেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী।
আসমাদের কথা-বার্তা, পোশাক ও তাদের সঙ্গে থাকা দালাল চক্রের আচরণে সন্দেহ হলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ী কিশোরীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আসমার পরিচয় ও ঠিকানা জানার সঙ্গে সঙ্গে কুতুবদিয়া থানার ওসিকে ঘটনা জানান। কুতুবদিয়া থানার ওসি দিদারুল ফেরদৌস ওই ব্যবসায়ীকে বিষয়টি ভারতের নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে জানানোর অনুরোধ করেন। পরে তিনি মুঠোফোনে কল করে স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করে।
ঘটনা বুঝতে পেরে দালালেরা আসমাদের রেখে পালিয়ে যায়। পরে আহমেদাবাদের আদালাজ পুলিশ স্টেশনের একটি পুলিশ টিম রেল স্টেশন থেকে বাংলাদেশি কিশোরীদের উদ্ধার করে। পরে ঘটনার জবানবন্দী নিয়ে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠায়। আসমাদের বয়স বিবেচনায় কারাগার থেকে একমাস পর একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা চিলড্রেন হোম ফর ওয়ার্কের জিম্মায় দেয় আদালত। সেখানে আসমাদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করাতেন মনোবিদ হার্ষা আগারওয়াল। তিনি বাংলাদেশি দুই কিশোরীর স্ব স্ব থানার ওসিদের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি পরামর্শ দিতেন কীভাবে সহজে তাদের স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যায়। তিনি আসমার বিষয়ে কুতুবদিয়ার ওসি দিদারুল ফেরদৌসের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলতেন।
বাংলাদেশি দুই কিশোরীর ভারতে পাচারের বিষয়টি ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ কনসুলেট অফিস এবং ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অবহিত কার হয়। এরপর শুরু হয় দুদেশের মধ্যে যোগাযোগ ও চিঠি চালাচালি।
পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে বাংলাদেশের রাইটস যশোর নামে একটি এনজিও। রাইটস যশোরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় আহমেদাবাদের চিলড্রেন হোম ফর গালর্স এনজিও’র।
অবশেষে ১১ মাস পর গত ১২ জুন রাত সাড়ে আটটার দিকে যশোরের বেনাপোল সীমান্তে ভারতের বর্হিগমন পুলিশ বাংলাদেশের বর্হিগমন পুলিশের কাছে আসমাদের হস্তান্তর করে। পরে তাদের বেনাপোল পোর্ট থানায় সোপর্দ করা হয়। ১৩ জুন সকালে বেনাপোল পোর্ট থানায় রাইটস যশোর এনজিও’র সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সহযোগিতায় আসমাদের বাবা-মা ও নিকট স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আসমা বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কুতুবদিয়ায় ফেরেন ১৬ জুন দুপুরে।
কুতুবদিয়ায় পৌঁছেই আসমা খাতুন কুতুবদিয়া থানার ওসি দিদারুল ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি আসমার হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দেন। এ সময় আসমার পরিবার সরকার ও ওসির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
কুতুবদিয়া থানার ওসি মো. দিদারুল ফেরদৌস, আসমা খাতুনের বাবা জাহঙ্গীর আলম ও আসমার সঙ্গে কথা বলে উল্লেখিত তথ্য জানা গেছে।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আসমার সঙ্গে আরেকজন কিশোরীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ওই কিশোরীর বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে আরও ৫০জন বাংলাদেশি নারী বর্তমানে সেখানকার বিভিন্ন সেফহোমে আছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে তাদের দেশে ফেরত আনতে বিলম্ব হচ্ছে। কুতুবদিয়ার কিশোরী আসমার সঙ্গে কথা বলে পুলিশসহ সরকারি অন্যান্য সংস্থা তৎপর হলে নারী পাচারকারি চক্রকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
Comments