সরকার-কৃষকের আস্থাহীন সম্পর্ক খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি
আমরা সবসময় যা চোখে দেখি তার ওপর ভিত্তি করে পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনার চেষ্টা করি। করোনাভাইরাসের এই বৈশ্বিক মহামারিতে আমরা কিছু মানুষকে ‘ফ্রন্টলাইনার’ বা ‘সম্মুখ যোদ্ধা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি। কারণ, তারা সামনে থেকে অসুস্থদের সেবা দিচ্ছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছেন।
আমাদের এই যোদ্ধাদের প্রথম সারিতে আছেন ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিক ও আরো অনেকেই। এসব পেশার মানুষজন সামনে থেকে যুদ্ধ করছেন। নিজেরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। তাদের মধ্যে অনেকে মারাও গেছেন।
কিন্তু, আরও এক পেশার মানুষ আছেন যাদের কাজ হচ্ছে দেশের যে কোনো পরিস্থিতে বাকি সব পেশার মানুষের পেটের খাবার যোগান দেওয়া। এই দুর্যোগকালেও তারা ঝুঁকি নিয়ে ফসল উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কৃষকরা সম্মুখ যোদ্ধাদের জন্য খাবার উৎপাদন করছেন।
কৃষকদের এই অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সম্মুখ সারিতে আমরা তাদের কোন কালেও দেখতে পাই না। এটা আমাদের অক্ষমতা। কিন্তু, তারা অদৃশ্য ছায়ার মতো আমাদের পাশে থাকেন সবসময়। দেশের বিপদে-আপদে ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় তারা সবসময়ই ‘ফ্রন্ট লাইনার’।
অথচ, স্বাধীনতার ৫০ বছর চললেও আমরা তাদের যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি। এই ব্যর্থতা রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
সরকার এবার বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে গত বছরগুলোর চেয়ে বেশি ধান কিনবে। আগে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, সরকার কৃষক প্রতি সর্বোচ্চ তিন মেট্রিক টন ধান কিনবে।
কিন্তু, গত ১৪ জুন খাদ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকার মাঝারি ও উচ্চ পর্যায়ের কৃষকদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৬ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে। গত বছরের তুলনায় সরকার এবার বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে দ্বিগুণ ধান সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। গত বছর ছিল ৪ লাখ মেট্রিক টন। এবার সেটা হয়েছে ৮ লাখ মেট্রিক টন।
সরকার এবার বেশি ধান-চাল সংগ্রহ করছে কারণ হলো এই মহামারিতে উপার্জনহীন গরিব-অসহায় মানুষের ঘরে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে হয়তো সেই জন্য।
এটা তো গেল শুধুমাত্র করোনা বিপর্যয় মোকাবেলার বিষয়। অন্যদিকে, আরো প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঘুর্ণিঝড় ‘আম্পান’র জন্য ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ এখনো জোয়ার-ভাটার জলে খাবি খাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বগুড়ার আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার উত্তরবঙ্গে বড় ধরনের বন্যার আশংকা রয়েছে। আগাম বৃষ্টিপাতের কারণে ইতোমধ্যে দেশের নদীগুলো ভরে গেছে। অধিক বৃষ্টিপাত হলে তা বড় বন্যায় রূপান্তরিত হবে। তাই সরকার যা ভাবছে তার থেকে বেশি খাদ্য সহায়তা লাগবে মানুষের।
সরকার এবার ধান-চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে গত দুই মাসে তার সামান্য পূরণ করতে পেরেছে। গত ১৪ জুন খাদ্য অধিদপ্তের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সরকার কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ২৯,০০০ মেট্রিক টন ধান কিনতে পেরেছে নির্ধারিত ৮ লাখ মেট্রিক টনের এর মধ্যে। এটি লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪ শতাংশ।
সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ শেষ হবে আগস্ট মাসেই। মনে হয় সরকার এবার ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম নাও হতে পারে। এর পেছনে কারণ হলো, কৃষকরা এবার সরকারের কাছে ধান বিক্রি করছেন না। পাশাপাশি চালের উদপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চালকল মালিকরাও সরকারকে চাল দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন।
গত ১৬ জুন পর্যন্ত বগুড়ার খাদ্যনিয়ন্ত্রক মিলারদের কাছে থেকে চাল কিনতে পেরেছেন মাত্র ১২ হাজার মেট্রিক টন যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১০ শতাংশ।
গাইবান্ধায় এবার বোরো ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ২৩ হাজার মেট্রিক টন। চাল সংগ্রহের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও একই পরিমাণ। কিন্তু, গত ১৮ জুন পর্যন্ত গাইবান্ধায় চাল সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন। কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ২,৫০০ মেট্রিক টন। প্রায় সারা দেশেই ধান-চাল সংগ্রহের চিত্র মোটামুটি একই রকম।
বগুড়ায় খোলা বাজারে বর্তমানে ধানের যে দাম তাতে কৃষক মোটা জাতের ধান স্থানীয় আরতদার বা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করছেন মন প্রতি ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায়। চিকন জাতের প্রতি মন ধান বিক্রি করছেন ৯৫০ থেকে ১,০০০ টাকায়। অন্যদিকে, সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছেন প্রতিমন ১০৪০ টাকায়। অর্থাৎ সরকার যে দাম দিচ্ছে খোলা বাজারে ধানের দাম তার চেয়ে এখনও কম আছে।
তাহলে প্রশ্ন, কেনো কৃষকরা এই বিপদকালে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করছেন না? কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবার ধানের বাজার দর ভালো। কিন্তু, ভালো বাজার দরই একমাত্র কারণ নয়। এর পিছনে আছে কৃষকের চাপা কষ্ট, ক্ষোভ, হতাশা ও অজানা নানা গল্প।
১. কৃষক সরকারের কাছে ধান দিতে চায়। কিন্তু, বছরের পর বছর ঘুরেও তালিকায় নাম উঠাতে পারেন না। সরকার খুব কম কৃষকের কাছে ধান কিনেন। বগুড়া জেলায় মোট কৃষকের সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ। কিন্তু, লটারিতে নাম ওঠে মাত্র কয়েক হাজার কৃষকের।
বগুড়ায় এবার মোট বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে ১৪ লাখ মেট্রিক টন। অথচ সরকার সারা দেশে কিনবে মাত্র ৮ লাখ মেট্রিক টন। সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চাইলে কৃষককে তার নিজ খরচে সরকারি খাদ্য গুদামে ধান দিয়ে আসতে হয়। টাকা পেতে অনেক সময় দালালের সাহায্য নিতে হয়। ধান বিক্রির টাকা সরাসরি কৃষক হাতে পায় না। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। ফলে কৃষক হয়রানির শিকার হন।
২. সরকারের কাছে ধান বিক্রির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ধানের আর্দ্রতার নির্দিষ্ট চাহিদা। এক্ষেত্রে, ধানের আর্দ্রতা থাকতে হবে ১৪ শতাংশ বা তার নিচে। কিন্তু, বেশিরভাগ কৃষক বার বার ধান রোদে শুকিয়েও এই আদ্রতা নিয়ে আসতে পারেন না। কৃষকের বাড়িতে আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নেই। ফলে সরকারের কাছে ধান বেচতে হলে ধানের নমুনা সরকারি খাদ্য গুদামে নিয়ে যেতে হয় কয়েকবার। বাজারে সেই আর্দ্রতার কোনো বলাই থাকে না। তাছাড়া, ব্যবসায়ীরা কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়েও ধান কিনে থাকেন।
৩. সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে থাকে। বেশিরভাগ কৃষক তার আগেই ধান বিক্রি করে দেন। দেশের বেশিরভাগ কৃষকই ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক পর্যায়ের। তাদের অনেকের নিজের জমি নেই। জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। পাশাপাশি অনেকে ধানের জমি চাষ করেন বাকিতে। সার-কীটনাশক কিনেন বাকিতে। ফসলে সেচ দেন বাকিতে। তাই ধান না পাকতেই পাওনাদাররা তাদের ওপর এক ধরনের মানসিক নির্যাতন চালাতে শুরু করে। সরকার কখন ধান কিনবে কিংবা লটারিতে তাদের নাম থাকবে কিনা এতকিছু ভাবার সময় কৃষকের থাকে না।
ধান পাকতে না পাকতেই তা কেটে পাওনাদারদের ঋণ শোধ করতে হয়। এই মহামারিতে সব কিছুর দাম যখন বেড়ে গেছে তখন পারিবারিক চাহিদা মিটাতে হিমশিম খাচ্ছেন সব কৃষকই।
অনেক কৃষক বলেছেন, সরকার আমাদের বিপদে পাশে থাকে না। কোন সেবাটা কৃষক বিনামূল্যে পায়? এই যে এই লকডাউনে কৃষক পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও সেবা মিলছে না। তাহলে সরকার যদি খাদ্য সংকটে পড়ে তাহলে কৃষক কেন ধান দিবে?— এমন প্রশ্নও তুলেছেন অনেকেই।
এবার সরকার কি ধান-চাল পাবে না? নিজ দেশে না পেলে বিদেশে কি পাবে? হয়তো পাবে। তা প্রয়োজনের থেকে অনেক কম। তাও আবার অনেক চড়া মূল্যে আমদানি করতে হবে। তাছাড়া গোটা বিশ্বই জানে, করোনা মহামারির জন্য পরবর্তী বছরগুলোতে দেখা দিবে খাদ্য সংকট। একমাত্র ‘বোকা’ রাষ্ট্রগুলোই কেবল ধান-চাল বা খাদ্য রপ্তানির ঝুঁকি নিবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অন্য দেশ থেকে খাদ্য পাওয়ার সম্ভাবনা এবার অনেক কম থাকবে।
বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কৃষকরা ধান দিচ্ছেন না, মিলাররা চাল দিচ্ছেন না, তাহলে সরকার কী করবে? বগুড়ার খাদ্যনিয়ন্ত্রক বলেছেন, কৃষকরা ধান না দিলেও চালের অভাব হবে না। মিলাররা আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। চাল না দিলে মিলাররা কালোতালিকা ভুক্ত হবেন। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের কাছ থেকে চাল নেওয়া হবে।
অন্য দিকে মিলাররা বলছেন, সরকার এবার যে দরে চাল কিনছেন (প্রতি কেজি ৩৬ টাকা) সেই দরে চাল দিলে তারা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেজি প্রতি তাদের লোকসান গুণতে হবে ৭ থেকে ১০ টাকা। তাই এবার তারা সরকারের কাছে চাল দিতে চান না।
তাহলে সরকার এবার কী করবে? সরকারের হাতে বিকল্প কী? বেশি দাম দিয়ে খাদ্য আমদানি করতে হবে বিদেশ থেকে। তাতেও সন্দেহ আছে যে অন্য দেশগুলো চাল রপ্তানি করবে কিনা। সরকারকে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকেই খাদ্যশস্য কিনতে হবে। আর সেটা কিনতে হবে ঠিক সময়ে। কারণ মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি মুনাফার আশায় ইতোমধ্যেই বাজার থেকে অনেক ধান-চাল কিনে ফেলেছে।
প্রতি বছর সরকার কৃষককে সুবিধা দিতেই সরাসরি কৃষকের কাছে ধান কিনে। এবার সরকারকে নিজের প্রয়োজনেই কৃষকের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ধান কিনতে হবে। ব্যবসায়ী বা অন্য কোন দেশ থেকে যে টাকায় সরকারকে পরে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে সেই পরিমাণ টাকা যদি কৃষকরা সরাসরি পান তাহলে এই দুর্যোগকালে কৃষক বেশি ফসল ফলাতে আগ্রহী এবং সক্ষম হবেন।
তাই প্রয়োজনে অস্থায়ী লোকবল নিয়োগ করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারে সরকার। তা না হলে অচিরেই দেশে কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে এই মুহূর্তে সরকারের আজ কৃষকদের বড়ই প্রয়োজন। গত ৫০ বছরে সরকার কৃষকদের সঙ্গে যে আস্থাহীন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তার মূল্য অবশ্যই এবার দিতে হবে সরকারকে।
মোস্তফা সবুজ, দ্য ডেইলি স্টারের নিজস্ব সংবাদদাতা, বগুড়া
Comments