স্বকীয়তায় উজ্জ্বল সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সময়ের স্রোতে কত মানুষ বদলে গেছে, বৈষম্যের কারাগারে কত মুখ হারিয়ে গেছে, সংবাদপত্র যখনি এমন আশ্বাসহীনতার শিরোনাম করে, ঠিক তখনো একই রকম আদর্শ ও বিবেকের উদাহরণ হিসেবে স্বকীয়তায় হাজির হন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

সময়ের স্রোতে কত মানুষ বদলে গেছে, বৈষম্যের কারাগারে কত মুখ হারিয়ে গেছে, সংবাদপত্র যখনি এমন আশ্বাসহীনতার শিরোনাম করে, ঠিক তখনো একই রকম আদর্শ ও বিবেকের উদাহরণ হিসেবে স্বকীয়তায় হাজির হন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

সূর্যের কাছ থেকে যেমন ধার নিয়ে চলে বিভিন্ন গ্রহ, তেমনি তার কাছ থেকে আলো নিয়ে চলে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রচিন্তক ও দৈনিকের সম্পাদক।

তিনি একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী বলেই এমন দায়বদ্ধ। প্রতিনিয়ত আপডেট থেকে শিখেন-শেখান, জীবনের দীক্ষা দেন-নেন। তা ছাড়া, রচনা পড়ে দেখা যায়, তার দায় দেশ ও দশের প্রতি, রাষ্ট্রের পক্ষে তিনি চিন্তায় ও কাজে, লেখায় ও কথায় লড়ে যাচ্ছেন একজীবন। দীর্ঘ সংগ্রামের মাঝখানে কোনো বিভাজন রেখা রাখেননি। নৈতিকতার স্বার্থে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে বিলিয়ে দিচ্ছেন মেধা ও মনন!

সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল এই মুহূর্তে। আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে বস্তুবাদী সভ্যতা। এক্ষেত্রে একজন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর দর্শনের মৌলিকত্ব মানুষকে ভয়াবহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে বলে গবেষকদের অভিমত।

খ.

তারুণ্য দীপ্ত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন টানা ৬ দশক। নন্দিত হয়েছেন সামাজিক মুক্তির দিশারি নামেও। তিনি সৃষ্টিশীল ও মননশীল বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তার গ্রন্থের মধ্যে ‘ইনট্রোডিউসিং নজরুল ইসলাম’, ‘দ্বিতীয় ভুবন’, ‘এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব’,  ‘আমার পিতার মুখ’, ‘স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি’, ‘দরজাটা খোলা’, ‘উনিশ শতকের বাংলা পদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’, ‘উপর কাঠামোর ভিতরেই’, ‘পিতার হুকুম’, ‘আশির দশকের বাংলাদেশের সমাজ’, ‘শ্রেণি, সময় ও সাহিত্য’, ‘বাঙালি কাকে বলি’, ‘বিরূপ বিশ্বে সাহসী মানুষ’, ‘গণতন্ত্রের সন্ধানে’, ‘স্বাধীনতার স্পৃহা’, ‘বৃত্তের ভাঙাগড়া’, ‘বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ’, ‘ইংরেজি সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায়’, ‘ভালো মানুষের জগৎ’, ‘রাষ্ট্র ও কল্পলোক’, ‘দুই যাত্রায় এক যাত্রী’, ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’, ‘অবিরাম পথ খোঁজা ও সময় বহিয়া যায়’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তার প্রতিটি রচনার ভাষায় যেমন সৌন্দর্য, শব্দ নির্বাচনে যেমন মনীষা, বাক্যগঠনে যেমন সারল্যময় পাণ্ডিত্য, বিশ্লেষণে যেমন সতর্কতা ও লালিত্য, বিষয় নির্বাচন এবং উপস্থাপন শৈলীও তেমন অসামান্য।

সর্বোপরি অনুসন্ধানী পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার অসাধারণ মুনশিয়ানা তাকে বাংলা ভাষার অন্যতম প্রাবন্ধিকের আসনে অধিষ্ঠিত করে রাখছে। মহার্ঘ শব্দবন্ধে তিনি তার রচনাকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যান, যাতে পাঠক অভিভূত না হয়ে পারেন না। 

দেখা যায় তার বুদ্ধিবৃত্তিক লেখা ও আলাপে উচ্চস্বর মেধাহীন স্বার্থান্ধদের কোলাহল থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন; কিন্তু বিদগ্ধ পাঠকের অন্তর থেকে কখনোই তিনি দূরে থাকেননি। তার প্রমাণ মিলে অ্যাকাডেমিক, নন-অ্যাকাডেমিক আলোচনায়।

গ.

সমকালের একজন প্রতিনিধি হিসেবে সাহিত্যের অমসৃণ পথে চলতে গিয়ে স্যারের প্রতি মুগ্ধতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে আছে— চিন্তার নিজস্বতা, দেশপ্রেম, নিরহংকার, জাতীয়তাবোধ ও ব্যক্তিত্ব। এমন সাহিত্যকর্মের জীবনসাধক, প্রজ্ঞার অহং বর্জিত আলোকিত মানুষ হিসেবে জনসাধারণের কাছে পরিচিত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। রাষ্ট্র ও জনগণের নানান জটিল বিষয়চর্চায় মৌলিকত্ব ও প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন গবেষণা প্রবন্ধে ও শিক্ষকতায়। সংগত কারণেই স্বতন্ত্র বাংলাদেশের স্বপ্নে তার জীবন ও কর্মের প্রতি আগ্রহী হয়েছি।

সমাজ পরিবর্তনের আবশ্যকতায় বিশ্বাসী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। একইসঙ্গে রয়েছে তার বিভিন্ন বিষয়ে নিজস্ব চিন্তা। বাকস্বাধীনতা, মানবিক অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা তিনি। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের অবদানে উজ্জ্বল, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চা, এই দুইয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা বৈরী নয়। বরং একে অপরকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মার্কসবাদী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল। আশির দশকে ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে লেখা তার কলাম ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার সম্পাদিত পত্রিকা পরিক্রম, সাহিত্যপত্র, সাপ্তাহিক সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিজ উল্লেখযোগ্য। পাশাপাশি তার সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে নতুন দিগন্ত।

দেখা যায়, গতানুগতিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলানোর স্বার্থেই, অর্থাৎ মানুষের সামাজিক মুক্তির চিন্তায় প্রশ্ন ও চিন্তাকে অন্যের কাছে নিয়ে গেছেন বিরতিহীনভাবে। কখনো লিখে, কখনো সম্পাদনা করে ও বলে প্রচার করেন তার আদর্শ ও রাষ্ট্রের সংকট সম্ভাবনা।

ব্যক্তিগতভাবে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। কিন্তু, সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে নানা কথা চালু আছে দেশে। তিনি সমাজতন্ত্রের সেই কূটতর্কের মধ্যে কখনোই প্রবেশ করেননি। তিনি সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে জীবনমানের উন্নয়নকেই সমাজতন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সব সময় তিনি বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে তার চিন্তাকে সুতীক্ষ্ণভাবে ধরে রেখেছেন। দার্শনিক দিক থেকে হয়তো এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু একজন অঙ্গীকারবদ্ধ লেখকের যে জীবনব্যাপী সাধনা, সেখান থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি।

প্রাসঙ্গিকভাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত তরুণ ইংরেজ কবি এল্যান লুইস (অবিভক্ত ভারতের) সমাজ জীবন দেখে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা উল্লেখ করছি—

‘এ দেশে পরিণতি তথা মানসিক পরিপূর্ণতা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। মানুষের পরিবেশ দেখে ক্রুদ্ধ হওয়ার মতো এতো এতো বস্তু এখানে রয়েছে যে সংযতমনা হওয়া সম্ভব নয়। সমাজের চেহারায় দিশেহারা হওয়ার মতো বস্তু অনেক...’।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাও অর্ধশত বছর, কিন্তু সামাজিক মুক্তি আসেনি। তাই লুইসের কথাটি এখনো ভাবায়। রাষ্ট্র ও জনগণের সার্বিক উন্নয়নে তার নানান চিন্তা গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে। যারা বাংলা ভাষা ও বাঙালির জাতীয়তা সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে জানতে চান, তাদের কাছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনন্য ব্যক্তিত্ব আজ ও আগামীকালের।

রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক ও আদর্শ নাগরিকের মতাদর্শ জানা ও বোঝার জন্য তার প্রাসঙ্গিকতা থাকবে প্রতিদিন।

ইমরান মাহফুজ, কবি ও গবেষক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

3h ago