স্মৃতিচারণ

ডা. জহিরুল: বিএসএমএমইউর প্রথম করোনা শহীদ

বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক সার্জারির অধ্যাপক ডা. গাজী জহিরুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৮৯ সালে। যখন আমি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অধ্যাপক সেলিম ভুইয়া স্যারের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে সার্জারি ইউনিটে কর্মরত ছিলাম। গাজী জহিরুল হাসান সেদিন সার্জারি আউটডোরের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরিচয় আরও নিবিড় হলো যখন জানলাম তিনিও আমার বন্ধু ডা. হোসেন তৌফিক ইমাম লিটনের বন্ধু। তিনি ছিলেন এম-১৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার সহপাঠী অনেকেই আমার ঢাকা কলেজের পূর্ব পরিচিত বন্ধু হওয়ায় আমাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়।

মাঝখানে আমি ঢাকা মেডিকেলে বদলি হওয়ায় যোগাযোগের সাময়িক বিরতি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হয়, তার কিছুদিন আগে তিনি রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগ) হিসেবে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে নতুন করে পুরাতন বন্ধুত্ব গতি পায়। আমি তখন ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

আমাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে এবং একপর্যায়ে পেডিয়াট্রিক সার্জারিতে মাস্টার্সে (এমএস) ভর্তি হন। যথাসময়ে শিক্ষা সমাপন করে স্ববেতনে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অত্র বিভাগে যোগদান করেন ২০০৬ সালের ৪ এপ্রিল। ২০০৭ সালের ২ জুলাই তিনি নিয়মিত হন। এভাবেই যথারীতি ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান।

তার যে একটা ডাক নাম আছে, সেটা তার মৃত্যুর এক দিন আগে আমার ছোট ভাই সালেকের (অধ্যাপক একেএম সালেক) মাধ্যমে জানতে পারি। তার ডাক নাম ছিল রকেট। সালেক পুরান ঢাকায় তার প্রতিবেশী ছিল। পরবর্তীতে জহির বর্তমান বাসস্থান খিলগাঁওয়ে বসবাস শুরু করে। বাবা মরহুম মো. গাজী শফিউদ্দীন ও মা মরহুমা ফিরোজা বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে জহির ছিলেন সবার বড়। ছোট ভাই ও বোন মিলে তাদের এক সুখের সংসার।

ব্যক্তি জীবনে তার সহধর্মিণী সারওয়াত হাসান মুন একজন শিক্ষিকা। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মোসলেম উদ্দীন খান হাবু মিয়ার মেয়ে। জহিরের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে অনুপম ঢাকা ব্যাংকে চাকরি করেন আর ছোট ছেলে অনিন্দ্য আহসান উল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগে আমাদের সম্পর্ক ছিল আপন ভাইয়ের মতো। বয়সে খুব কাছাকাছি বা সমবয়সী হওয়ায় আমাদের সম্পর্ক ছিল আন্তরিক, দৃঢ় ও বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। অনেকেই আমাদের নিয়ে বলতেন যে, শিশু সার্জারি বিভাগের সবাই এক সঙ্গে চলাফেরা করে।

মানুষের জন্য জহির খুব অনন্তপ্রাণ ছিলেন। রোগীর সেবায় তিনি অনেক যত্নবান ছিলেন। আমাদের নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। তার গল্প বলা ছিল অসাধারণ। মজাদার মানুষ ছিলেন। তার ব্যবহার ছিল দিলখোলা। টুকটাক মনোমালিন্য যে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তিনি অনেক আবেগপ্রবণ ছিলেন। হিট অব দ্য মোমেন্টে অনেক কথা বললেও পরক্ষণে তা ভুলে যেতেন। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতেন।

সহকর্মী, শিক্ষার্থী, অফিস কর্মচারী, নার্স ও সেবাকর্মীদের সঙ্গে ছিল তার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। তিনি আবার আমাদের বিভাগের কোর্স কোঅর্ডিনেটর ছিলেন। শিক্ষার্থীদের জন্য তার হৃদয় ছিল অনন্তপ্রাণ। কীভাবে তাদের উপকার করা যায়, সারাক্ষণ তাই ভাবতেন। ব্লক এক্সাম বা কোর্স ফাইনাল পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী খারাপ করলে তার মন খারাপ হতো।

মাঝে মাঝে মনখারাপ হলে তিনি আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। তার গল্পের অধিকাংশজুড়ে থাকত তার বাকপ্রতিবন্ধী ছোট ভাইয়ের বিষয়। তাকে (ছোট ভাইকে) যে কী পরিমাণ ভালবাসতেন, তার প্রমাণ অনেক আছে। দুই ছেলেকে নিয়েও তার উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। ছোট বোন, বোনের জামাই, চাচাদের পরিবারসহ নিকটাত্মীয়দের সবাইকে নিয়ে তিনি ভাবতেন। ঘরের গৃহকর্মী, ড্রাইভার, মসজিদের ইমামসহ তার বাসার বাইরের লোক ছিল অনেক। তাদের কারো কথা বাদ যেত না। তার আব্বা ছিলেন আইনজীবী। তার আব্বার আমলে রাখা কাজের লোক ও আম্মার সঙ্গে থাকা গৃহকর্মীকে তিনি বিদায় করেননি। কষ্ট হলেও তাদেরকে নিয়েই তিনি চলার চেষ্টা করতেন। সেজন্যে তাকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে হতো। পুরান ঢাকায় চেম্বারসহ আধুনিক ঢাকাতেও তাকে চেম্বার বা প্র্যাকটিস করতে হতো।

২০১০ সালে শেয়ারবাজারে তার কিছু বিনিয়োগ ছিল। সেখানে তার অনেক টাকার ক্ষতি হয়ে যায়। লোন করার জন্য অনেক বড় সমস্যায় পড়ে যান। যা পরবর্তীতে আমাদের সকলের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠেন। আমাদের বিভাগে কোনো অনুষ্ঠানে খাওয়ার মেন্যুটা জহিরই করে দিতেন। ব্যক্তি জীবনে একজন ভোজনরসিক ছিলেন। তার ডায়াবেটিস ছিল, ইনসুলিন নিতেন, রক্তচাপও ছিল। কিন্তু, তার চলনে-বলনে কখনো মনে হতো না। যেদিন আমার প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়লো তিনি আমাকে হতাশ না হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তার সঙ্গে আমাদের অনেক অনেক স্মৃতি। কোনটা লিখবো, কোনটা না, বুঝতে পারছি না। আমি সন্দীপের সন্তান। ৮০’র দশকে বসতভিটা বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। তা তিনি জানতেন। এজন্য প্রায়ই তার গ্রামের বাড়ির গল্প বলতেন। তিনি তার বাড়ির কাছে আমাকে জমি কিনে দিয়ে বাড়ি করার কথাও বলতেন। বলতেন, ‘শেষ জীবনে দুই ভাই এক সঙ্গে সময় কাটাবো’। তার গ্রামের বাড়ি দোহারের জয়পাড়ায়। আগে অনেক কষ্ট করে যেতে হতো। ইদানিং অনেক সুন্দর রাস্তা হয়েছে। তার বাড়ির কাছেই পদ্মা নদী। সেখানে মিনি কক্সবাজার নামে একটা নতুন পর্যটন কেন্দ্র হয়েছে। কথা ছিল আগামী শীতে ডিপার্টমেন্ট থেকে সবাই মিলে পিকনিক করতে যাব। আর যাওয়া হলো না!

নিজের বাসা সংস্কার করার সময় তিনি আমাদেরকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। শেষ একবার তার বড় ছেলের চাকরি হওয়ায় আমাদের শিশু সার্জারির সবাইর পরিবারসহ এক মিলন মেলার আয়োজন করেন।

গত ৩০ মে তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা আমার অফিসকক্ষে। শেষ কথা ছিলো, ‘দোস্ত ১ জুনের মিটিংয়ে আসতে পারব না’। এটাই যে তার শেষ কথা, এটাই যে তার সঙ্গে শেষ দেখা, তা কি আমি ভাবতে পেরেছিলাম...

৩১ মে থেকে তার জ্বর ও শরীর ব্যথা শুরু হয়। ৩ জুন বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। মাঝেমধ্যে অক্সিজেনও দিতে হচ্ছিল। ৫ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো অনেকটা তার মনের বিরুদ্ধে।

০৬ জুন সেখানকার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হলো এবং ভেন্টিলেটর দেওয়া হয়। এরপর যদিও সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে ১২ জুন রাত ১টা ১৮ মিনিটে ৫৮ বছর বয়সে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।

রকেট (তার ডাকনাম)! রকেটের মতো এসে সব জয় করলেন। আর মাত্র ১৩ দিনে (করোনায়) আবার রকেটের মতো চলে গেলেন সব ফেলে।

বন্ধু হয়ে আমাদেরই হৃদয় মাঝে, গাজী জহির তুমি চিরদিন থাকবে। পরকালে ভালো থাকো, আল্লাহ তোমাকে শহীদের মর্যাদা দিবেন, তুমি অপেক্ষা করো, আমাদেরও একদিন তার কাছে ফিরে যেতে হবে। আবার দেখা হবে, এই অপেক্ষায় থাকলাম...

তবে, একটা দুঃখ থেকে যাবে যে, দেশের শ্রেষ্ঠতম চিকিৎসালয়ের শিক্ষক হয়েও বিএসএমএমইউতে তোমাকে চিকিৎসা দিতে পারিনি। এজন্য যদি পারো তো আমাদের ক্ষমা করে দিও। এর জন্য আমরা যারা দায়ী, তাদেরও তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি আশা করব যে তোমার মৃত্যুর পরও যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না হয়। আশা করি চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য চিকিৎসাসেবা কর্মীদের জন্য এই বাংলায় ডেডিকেটেড হাসপাতাল হবে। সেখানে সবাই চিকিৎসা পাবে। তবেই হয়তো তোমার আত্মা শান্তি পাবে।

অধ্যাপক ডা. মো. তোসাদ্দেক হোসেন সিদ্দিকী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান।

Comments

The Daily Star  | English

Power grid failure causes outage across 21 districts

According to the Power Grid Bangladesh PLC, the situation has since returned to normal

7h ago