মন্ত্রীর ধমক এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দুঃখ প্রকাশ

গত মে মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল করোনাভাইরাস হয়ত পৃথিবী থেকে বিদায় নাও নিতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। ছবি: সংগৃহীত

গত মে মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল করোনাভাইরাস হয়ত পৃথিবী থেকে বিদায় নাও নিতে পারে।

ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীও গত কয়েক মাস ধরেই পূর্বাভাস দিচ্ছেন, করোনাভাইরাস আগামী ১৮ থেকে ২৪ মাস পৃথিবীতে স্থায়ী হতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানীদের গবেষণা পর্যালোচনা করেই হয়ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ করোনাভাইরাস মহামারির সম্ভাব্য সময়কাল জানিয়ে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন।

তিনি করোনা মহামারি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছিলেন।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরেরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক ভিডিও বার্তায় ধমকের সুরেই গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য প্রদানকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য’ বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার যখন দিন-রাত পরিশ্রম করে মানুষের মনোবল চাঙা রাখার জন্য নিয়মিত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন, করোনা যোদ্ধাদের প্রতিনিয়ত সাহস দিচ্ছেন, তখন স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কোনো কোনো কর্মকর্তার করোনার আয়ুষ্কাল নিয়ে অদূরদর্শী ও কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য জনমনে হতাশা তৈরি করছে।’

জনগণের মাঝে শুধু হতাশা নয়, অনিশ্চয়তা, বেদনা, ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তবে সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের তথ্য তুলে ধরার জন্য নয়।

অক্সিজেন, আইসিইউয়ের অভাবে অসহায়ের মত হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেও একজন পিতা তার আদরের সন্তানকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণায় যখন হাসপাতালের বারান্দায় গগনবিদারী চিৎকার করছে, পুরো জাতি তখন সত্যিকার অর্থে শুধু হতাশ নয় ব্যথিতও হয়েছে।

মহামান্য হাইকোর্টের হস্তক্ষেপেই যখন পুরো জাতি জানতে পারে সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৭৩৩টি আইসিইউ শয্যা আছে, আমরা সত্যি তখন হতাশ না হয়ে পারিনি।

এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং হতাশার যে, বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার তিন মাস পার হলেও আমাদের জেলা হাসপাতালগুলো এখনও কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা বা ভেন্টিলেটর না থাকায় শ্বাসকষ্ট থাকা জটিল করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত নয়।

যদিও বেশিরভাগ হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে, কিন্তু তাদের অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ঘাটতি রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডাটাবেস অনুসারে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৪৭টি জেলাতেই আইসিইউ সুবিধা নেই।

আমরা হতাশ হই, যখন জেলার একজন রোগীর করোনা রিপোর্টের ফলাফল আসতেই বেশিরভাগ সময় ১০ দিনের বেশি লাগছে।

দেশের ৬৪ জেলায় ৬৪টি আরটি-পিসিআর ল্যাব বসাতে কি তিন মাস সময় যথেষ্ট নয়?

ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) নামে সম্মুখ যোদ্ধা প্রিয় চিকিৎসকদের রেইনকোট পরানো হয়েছে, নকল এন-৯৫ মাস্ক দেওয়া হয়েছে। পুরো জাতির কাছে আপনাদের এই কাজগুলো ছিল চরম হতাশা আর বেদনার।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সোমবার পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মোট ৪৪ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। এ ছাড়া, করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আট জন চিকিৎসক। এ ছাড়া মোট ১ হাজার ৩১ জন চিকিৎসক এই ভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছেন। যা খুবই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক।

মন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি এই ধরনের সমন্বয়হীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য থেকে নিজেদের বিরত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ার কারণ হচ্ছে লকডাউনের বিভিন্ন ধাপ সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সেখানেই সত্যিকার অর্থে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও সমন্বয়হীনতার অভাব ছিল।

সমন্বয়হীনতা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কতটুকু লোপ পেলে চাকরি হারানোর ভয়ে করোনা সংক্রামণের ঝুঁকি নিয়েও দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে আসতে বাধ্য করা হয়।

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ তার দেওয়া তথ্যের জন্য যখন গভীর দুঃখ প্রকাশ করছিলেন। তখন তাকে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।

তিনি তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশ একটি জনবহুল এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। অপরপক্ষে করোনাভাইরাসও একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাস। এই কারণে অসতর্ক চলাফেরা এবং স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে না চললে এ দেশে সংক্রমণের হার মোকাবিলা করা কঠিন।

তিনি আরও বলেছিলেন, দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখলে কর্মহীনতা, আয় রোজগারের পথ বন্ধ হওয়া এবং অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে ব্যাপক অপুষ্টি, রোগবালাই এমনকি মৃত্যু ঘটতে পারে। সে কারণে জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সরকারকে কাজ করতে হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন স্বাভাবিকতা বা নিউ নরমাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং আমাদের জীবন আচরণকে এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।’

লন্ডনের বিখ্যাত ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক্সের অধ্যাপক অ্যাডাম এইচ আর ফিন মনে করেন, যদি কোনো ভ্যাকসিন না পাওয়া যায় বা এটি দীর্ঘ সময় নেয়, তবে আমাদের ভাইরাসটির সঙ্গে বাঁচতে শিখতে হবে। ঠিক যেমনটি আমরা ভ্যাকসিন পূর্বের যুগে অন্যান্য অনেক সংক্রমণে সঙ্গে করেছিলাম।

আমেরিকায় সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ক প্রধান এবং হোয়াইট হাউস টাস্কফোর্সের সদস্য ড. অ্যান্টনি ফওসি বলেন, ‘করোনা কোথায় গিয়ে শেষ হবে? আমরা এখনও তা সত্যিই বোঝার শুরুতে আছি।’

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব মতে, এখন পর্যন্ত গোটা বিশ্বে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৯১ লাখ ৯৯৪ জন। মৃত্যু হয়েছে চার লাখ ৭২ হাজার ৭০৩ জনের।

বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ১৯ হাজার ৭৭৫ জন। মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৫৪৫ জন। সুস্থ হয়েছেন ৪৭ হাজার ৬৩৫ জন।

আমরা আশা করব করোনা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) প্রদত্ত পরামর্শগুলো সরকার মেনে চলবে এবং তাদের সুপারিশগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করবে।

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

10h ago