ব্রহ্মপুত্র পাড়ের রাখালদের সংগ্রামী জীবন

গরুর পাল নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে ভাসতে ভাসতে এক চর থেকে আরেক চরে ঘাসের খোঁজে যান রাখালরা। খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে গরুকে খাইয়ে সন্ধ্যের আগে বাড়িতে ফেরেন তারা। এভাবেই চলে তাদের প্রতিদিনকার কর্মকাণ্ড।
এই রাখালেরা দেশের রাজনীতির খবর তেমন না রাখলেও, ব্রহ্মপুত্র নদের পানির খবর থাকে তাদের কাছে। খবর থাকে, কোন চরে গরুর জন্য কী খাবার পাওয়া যায়। আর তাদের বিনোদন বলতে, রাখালেরা এক সঙ্গে হয়ে গল্প করা, গান করা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাঁশি ও দোতারায় সুর তুলতে দক্ষ। ভাওয়াইয়া আর ভাটিয়ালি তাদের প্রিয়।
রাখালদের অধিকাংশই মাসিক বেতনে অন্যের গরু দেখাশোনার কাজ করেন। কেউ কেউ নিজের গরু চরান।
চরে গরুর রাখালরা খোরাকিসহ মাসে ছয় থেকে ১০ হাজার টাকা বেতন পান। প্রত্যেক রাখালের দায়িত্বে থাকে একটি করে গরুর পাল। প্রত্যেক পালে থাকে ১০ থেকে ১৫টি গরু।
কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, রৌমারী, রাজিবপুর ও চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের শতাধিক চরে সারাদিন ধরেই রাখালদের দেখা যায় গরু চরাতে।
অষ্টমীর চরের গরুর রাখাল আফজাল হোসেন জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই রাখাল হিসেবে কাজ করে আসছেন। এটাই তার জীবিকা। ১৫টি গরুর একটি পাল নিয়ে তাকে প্রতিদিন ছুটতে হয় বিভিন্ন চরে। খাওয়াসহ মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পান তিনি।
আফজাল বলেন, ঘাসের খোঁজে প্রতিদিন গরুসহ তাকে কমপক্ষে চারবার ভাসতে হয় ব্রহ্মপুত্রের বুকে। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পালের গরুগুলোও সাঁতারে বেশ দক্ষ বলে জানান তিনি।
একই চরের রাখাল মিলন ইসলাম বলেন, ঘুম থেকে উঠে গরু নিয়ে চরে যাওয়া, আর গোধূলিতে ফিরে আসা তার নিত্য দিনের জীবন।
তিনি জানান, চরে হঠাৎ ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে গরু নিয়ে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। তবে এর সঙ্গে তারা অভ্যস্ত।
ব্রহ্মপুত্রের চর কোদালকাটির রাখাল খালেক ইসলাম জানান, তারা চরে গরু চরালেও তাদের কেউই গরুর মালিক নন। কেউ কেউ পালের মধ্যে নিজের গরু আনতে চাইলে, পালের মালিকের বাধার মুখে পড়তে হয় বলে জানান তিনি।
তিনি জানান, দুপুরে তাদের খাবার জোটে না। সকালে ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। দিনের পর দিন কেটে যায় একই রুটিনে।
ব্রহ্মপুত্রের চর যাদুরচরের গরুর মালিক সোলেমান আলি জানান, তার ১৫টি গরুর একটি পাল রয়েছে। আর এজন্য মাসিক ৯ হাজার টাকা বেতনে একজন রাখাল আছে। প্রতি বছর গরু বিক্রি করে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় করেন তিনি। চরে গরু পালন করায় তাকে কোনো গো-খাদ্য কিনতে হয় না।
রাখালরা গরুর সারাদিনের খাবারের ব্যবস্থা করেন জানিয়ে তিনি বলেন, গরু নিয়ে তারা যেভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ সাঁতরে এক চর থেকে অন্য চরে যায়, তা সত্যিই দুঃসাহসিক।
কুড়িগ্রাম প্রাণিসম্পদ বিভাগের ভেটেরিনারি সার্জন গোলাম ফারুক বলেন, চরের গবাদি পশু রোগে বেশি একটা আক্রান্ত হয় না। চরের লোকজন যেমন কর্মঠ ও সংগ্রামী, তেমনি চরের গরুগুলোও সংগ্রামী।
প্রাণী সম্পদ বিভাগের কর্মচারীরা চরাঞ্চলে ঘুরে কৃষকদের পশু পালনে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।
Comments