বিসিবির সামনে পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জ: সাবের হোসেন চৌধুরী
অন্যান্য দেশের বোর্ডগুলো ক্রিকেটকে ফের মাঠে ফেরাতে নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন খেলা পুনরায় চালু করা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এখনও রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে। স্পষ্টতই, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির দিন দিন আরও অবনতি হচ্ছে। যে কারণে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে বিসিবিকে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। তবে বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া ও বৃত্তের বাইরে গিয়ে ভিন্নধর্মী কিছু চিন্তা করার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের বোর্ড। দ্য ডেইলি স্টারের মাজহার উদ্দিনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন বিসিবি প্রধান কথা বলেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, যেগুলোর উপর সামনের দিনগুলোতে বিসিবির ফোকাস করা উচিত।
পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো তুলে ধরা হলো।
দ্য ডেইলি স্টার: ২০২০ সালে ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল টাইগারদের। আপনার কী মনে হয়, কোভিড-১৯ মহামারি কতটা প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে?
সাবের হোসেন চৌধুরী: করোনাভাইরাসের প্রভাব হলো বৈশ্বিক, অভূতপূর্ব। আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়কে এটি প্রভাবিত করছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জীবন বাঁচানো যেখানে অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, খেলাধুলার সেখানে অগ্রাধিকার নেই। প্রত্যেক বোর্ডকে এরই মধ্যে ভুগতে হয়েছে, সামনেও ভুগতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতকে দেখুন। আন্তর্জাতিক সূচিসহ ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) স্থগিতের কারণে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা। ২০২০ সালটি বাংলাদেশের জন্য ফলদায়ক হওয়ার কথা ছিল। অথচ তা পরিণত হয়েছে নিষ্ফলা বছরে। তাই মহামারি পরবর্তী পরিস্থিতি এবং কীভাবে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তা নিয়ে চিন্তা করা বিসিবির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দ্য ডেইলি স্টার: পরিস্থিতি সামাল দিতে বিসিবির দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত?
সাবের হোসেন চৌধুরী: পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সৃজনশীল ও বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা-ভাবনার পাশাপাশি টিম ওয়ার্ক ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবে বর্তমানে বিসিবিতে চলছে ওয়ান ম্যান শো এবং বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বাছাই করা হয়েছে একদল পরিচালক, যারা সভাপতির প্রতিটি কথা এবং সব কথাতেই সায় দিয়ে একে অপরের চেয়ে বেশি কর্মদক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করে থাকে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াতে নিশ্চিতভাবেই বিসিবি সেসব করতে পারবে না। আমি গণমাধ্যমে এমন কিছু দেখিনি বা পড়িনি যা ইঙ্গিত দেয় যে, এই সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে কীভাবে আগে থেকে সচেতন থাকতে হবে তা নিয়ে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে বা অন্যান্য ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের এই যুগে, ভার্চুয়াল সভা এখন ব্যতিক্রম নয়, নিয়মে পরিণত হয়েছে।
আমি মনে করি, দ্বিপাক্ষিক মিথস্ক্রিয়া, আলোচনা এবং সমঝোতার মতো বিষয়গুলো এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে এবং একটি স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে, আইসিসির শক্তিশালী সদস্যরা তাদের ক্যালেন্ডার এবং সূচি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়াকে প্রধান্য দেবে। তাই বাংলাদেশের মতো দলগুলো তাদের অগ্রাধিকার না-ও পেতে পারে এবং যার ফলে আমাদের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা হয়তো আরও কমে যেতে পারে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং যোগাযোগের পাশাপাশি অন্যান্য বোর্ডের কাছে পৌঁছানো এবং তাদের সঙ্গে জড়িত হওয়া এখন আগের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিসিবির অবশ্যই কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, এটা জানার বেশ আগ্রহ রয়েছে যে, আমাদের সভাপতি এই মহামারি চলাকালীন কতবার সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং সবগুলো বোর্ডকে সাধারণ যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে মতবিনিময় এবং পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করেছেন কিনা। বিসিসিআইয়ের সভাপতি হওয়ার পাশাপাশি তিনি (গাঙ্গুলি) আইসিসির পরবর্তী সভাপতিও হতে পারেন।
দ্য ডেইলি স্টার: এ বছর এখন পর্যন্ত পাঁচটি সিরিজ স্থগিত করা হয়েছে। বিসিবির উপর আর্থিকভাবে এটি কত বড় প্রভাব ফেলবে? কর্মকর্তারা বলেছেন, আগামী চার-পাঁচ বছর চালিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা বিসিবির রয়েছে।
সাবের হোসেন চৌধুরী: হ্যাঁ, আমাদের রিজার্ভ রয়েছে। কয়েকশ কোটি টাকা বলে আমার মনে হয়। আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ এবং ক্রিকেটের বৈশ্বিক রাজস্ব আয়ের ভাগ পাওয়ার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তবে আমরা যদি মনে করি যে, আমাদের রিজার্ভ রয়েছে এবং সেকারণে যা-ই হোক না কেন, আমরা নির্ভার থাকতে পারি, তাহলে এটা হবে নির্বোধের মতো অপেশাদার এবং অগ্রহণযোগ্য কাজ। বিসিবিকে আগের তুলনায় আরও সক্রিয় হতে হবে এবং কীভাবে রাজস্ব আয়ের নতুন পথ তৈরি করা যায়, তা খুঁজে দেখতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা কি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) পারস্পরিক নির্ভরতার সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারি এবং এমন কিছু ইভেন্টের ব্যবস্থা করতে পারি, যা সম্প্রচার বা টিভি স্বত্বের মাধ্যমে এর সদস্যদের আর্থিকভাবে লাভবান করবে? মনে করে দেখুন, ২০ বছর আগে টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের আগে আমরা আইসিসির ক্রিকেট সপ্তাহ উদযাপনের জন্য ঢাকায় বড় বড় আন্তর্জাতিক ইভেন্ট যেমন স্বাধীনতা কাপ, মিনি বিশ্বকাপ এমনকি এশিয়া একাদশ বনাম বিশ্ব একাদশের একটি ম্যাচের ব্যবস্থা করেছিলাম।
দুর্ভাগ্যক্রমে, আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের অবস্থান হতাশাজনক। আইসিসির অন্যান্য পূর্ণ সদস্য দেশগুলো আগামীতে যখন তাদের সফরসূচী এবং প্রতিশ্রুতিগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাজানোর চেষ্টা করবে, তখন এই দুঃখজনক সত্যটি বাংলাদেশের মানকে নেতিবাচকভাবে প্রতিফলিত করবে। সুতরাং, বিসিবি এখন অনেকগুলো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে এবং বোর্ড কতটা কার্যকর ও দায়িত্বশীলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে তা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
দ্য ডেইলি স্টার: বিসিবি কীভাবে এবং কখন ঘরোয়া লিগ পুনরায় চালু করতে পারে?
সাবের হোসেন চৌধুরী: এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, বিসিবি আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোকে কীভাবে দেখে? এটা আর গোপন নেই যে, ঘরোয়া ক্রিকেটকে এর মর্যাদা অনুসারে গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি। পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, বিসিবি এখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো পারফরম্যান্স পুরোপুরি নির্ভর করে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের ভিত্তি কতটা শক্তিশালী, কাঠামোবদ্ধ এবং উপযুক্ত, এসবের উপর। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সৃষ্ট লম্বা বিরতিতে যে সময়-সুযোগ পাওয়া গেছে, তার কতখানি আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা এবং এটিকে ঢেলে সাজানো নিয়ে যত্নসহকারে ভাবতে বিসিবি কাজে লাগিয়েছে, তা জানার আগ্রহ রয়েছে আমার।
অবশ্যই, ঘরোয়া লিগ পুনরায় চালু করার সময় খেলোয়াড়দের পাশাপাশি ম্যাচ অফিসিয়াল এবং দলীয় কর্মকর্তাদের সুরক্ষাকে সবার আগে এবং সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফুটবল, রাগবি এবং অন্যান্য মাঠের খেলাগুলোর মতো ক্রিকেটে তেমন সংস্পর্শ ঘটে না। আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা থাকা গুরুত্বপূর্ণ এবং খেলোয়াড়দের নিয়মিত পরীক্ষা করাও জরুরী। খেয়াল করে দেখবেন, বিশ্বজুড়ে অনেকগুলি ফুটবল লিগ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং কয়েকটি ক্রিকেট বোর্ড যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে পুনরায় খেলা শুরু করার বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। মিরপুর রেড জোনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বোর্ড ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিয়ে বিকল্প ভেন্যুগুলোর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং সরকারের কাছ থেকে সার্বিক নির্দেশনা নিতে পারে। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, পুনরায় শুরু করা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নয়, বরং সমস্ত সম্ভাব্য বিকল্প সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত থাকা।
Comments