জার্মানির করোনা ব্যবস্থাপনা থেকে আমরা কী শিখতে পারি
করোনা মহামারিতে সারা পৃথিবীতে এর মধ্যেই ১ কোটির বেশি মানুষ কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হয়েছেন এবং ৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। সংক্রমণের শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত থাকলেও মৃত্যুর হার ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে মহামারির প্রথম অবস্থায় অত্যন্ত বেশি ছিল। এখন ইউরোপের দেশগুলো মৃত্যুর হার কমাতে সক্ষম হয়েছে।
ইউরোপের করোনা নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া নিয়েই আমার এই পর্যবেক্ষণ। কর্মরতভাবে ইউরোপের বহু দেশে বিগত ৪৫ বছর কাটানোর সুবাদেই এই ছোট্ট মহাদেশটার অনেক কিছুরই প্রশংসনীয় দিক নজরে এসেছে।
প্রথমেই যে দিকটা নিয়ে আলোচনা করতে হয় সেটা হলো ইউরোপের স্বাস্থ্যসেবা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রসহ অন্যান্য সব ইউরোপীয় দেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া হয় জনগণকে স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে।
আজ সুনিদিষ্টভাবে জার্মানির কথা বলছি। দেশটির প্রায় ৮ কোটি জনগোষ্ঠীর সবাই স্বাস্থ্যবীমার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন। এই স্বাস্থ্যবীমা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে। এর জন্যে অবশ্য প্রতিটি কর্মজীবী মানুষের বাধ্যতামূলকভাবে তার মাসিক আয়ের ৭ শতাংশ নিজের স্বাস্থ্যবীমায় জমা হয়, আর ৭ শতাংশ নিয়োগকর্তা প্রতিটি কর্মচারীর স্বাস্থ্য তহবিলে জমা করে।
সরকারও একটা অংশ সেই তহবিলে জমা করে। কারণ সবাই তো আর কর্মজীবী নন। বাচ্চারা ১৮ বছর পর্যন্ত এবং অনেক শারীরিক প্রতিবন্ধী আছেন তাই সরকার ও সমপরিমাণ হারে স্বাস্থ্যবীমায় জমা রাখে। এ সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হতে থাকে। যদি নিয়োগকর্তার পরিবর্তন হয় তখন নতুন নিয়োগকর্তা একইভাবে কর্মচারীদের জন্যে জমা করে। আর যদি কেউ বেকার হয়ে যান তখন ইম্পলয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ সেই কাজগুলোর দায়িত্ব নিয়ে নেয়।
এই জন্যেই জার্মানি একটি ধনতান্ত্রিক দেশ হলেও বলা হয় একটি জনকল্যাণ রাষ্ট্র। এখানে প্রতিটি নাগরিক চিকিৎসা ও শিক্ষা বিনা পয়সায় পান।
এছাড়াও, বাসস্থানের নিশ্চয়তা প্রতিটি মানুষকে রাষ্ট্র দিয়ে থাকে (বাসাভাড়া অবশ্য জনগণকেই দিতে হয়, যদি কারো উপার্জন কম থাকে তখন সরকার সহায়তা দেয়)।
জার্মানিতে স্বাস্থ্যসেবা, অবৈতনিক শিক্ষা, পেনশন ইত্যাদির জন্যে এই সুব্যবস্থা চ্যান্সেলর বিসমার্ক এর সময় তথা ১৮৮৩ সালেই চালু হয়।
যেহেতু চিকিৎসা প্রায় বিনামূল্যে দেওয়া হয় তাই করোনা মহামারিতেও জার্মানিতে কোভিড-১৯ টেস্ট থেকে শুরু করে নিবিড় পরিচর্যা, ভেন্টিলেশনের সব খরচ স্বাস্থ্যবীমা ও রাষ্ট্র বহন করে। গড়ে জার্মানিতে প্রতিদিন ১ লাখ ৭০ হাজার কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়।
জার্মানিতে আজ অবদি ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষের করোনা শনাক্ত হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ৮ হাজার ৯০০। এই হার তুলনামূলকভাবে অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্রের চেয়ে কম (৪ শতাংশ)। এর কারণ, সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। করোনার উপসর্গ দেখা দিলেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এখানেও লক্ষণীয় যে ৭০ বছরের বেশি বয়সের মানুষরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছেন। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা কাজ করেছে সেটা হলো গত তিনমাস সম্পূর্ণ লকডাউন করায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, বড় বড় কোম্পানি বন্ধ, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান হোম অফিসের ব্যবস্থা করেছে, শুধু খাবার সাপ্লাই ঠিক রেখেছে সুপার মার্কেটে, আর সরকার পুরো জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষতির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।
মার্চ মাসেই বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ইউরো দিয়েছে। প্রতিটি কর্মজীবী মানুষ তাদের মাসিক বেতন পেয়েছে। এছাড়াও, ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানি সবচেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছে। যাতে অন্যান্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো এই মহামারিতে অর্থ কষ্টের মধ্যে না পড়তে হয়।
জার্মানি পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তর জিডিপি আয়ের দেশ (৫ ট্রিলিয়ন ডলার ২০১৯ সালে)। দেশটি জিডিপির ২০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দিয়ে এই মহামারি ঠেকাতে এগিয়ে এসেছে। শুধু মানুষ বাঁচানোই নয়, পুরো অর্থনীতির ধস রক্ষার জন্যেই এই বিশাল প্রণোদনা।
উদাহারণ হিসেবে বলি, জার্মান এয়ারলাইনস লুফথহান্সা চার মাস ধরে তাদের প্রতিদিনের ৭ হাজার ফ্লাইট বাতিল করায় লাখ লাখ কর্মচারীদের বেতন ভাতা সরকার ১০ বিলিয়ন ইউরো প্রণোদনা হিসেবে দিয়েছে। তেমনি, বড় বড় মোটরগাড়ির কোম্পানি যেমন— বিএমডাব্লিউ, ভক্সওয়াগন, মার্সেডিস কোম্পানির লাখ লাখ কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করেছে, এবং সব রেস্তোরাঁ, কফি শপের কর্মচারীদের জন্যেও তাদের মাসিক বেতন পরিশোধ করেছে।
জিডিপির শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র (২১ ট্রিলিয়ন ডলার) দ্বিতীয় চীন (১৪ ট্রিলিয়ন ডলার) তৃতীয় জাপান (৬ ট্রিলিয়ন ডলার) ও চতুর্থ জার্মানি। বাংলাদেশ গ্লোবাল জিডিপির তালিকায় ৪১তম স্থানে আছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ জিডিপির ২০ শতাংশ কেন ১০ শতাংশও প্রণোদনা দেয়নি।
গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে কাজ প্রায় বন্ধ। মোট ৪১ লাখ শ্রমিকের অর্ধেক এখন কর্মহীন-বেকার। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মচারী ছাঁটাই করা শুরু করেছে। সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছিল তা গার্মেন্টস মালিকরাই ভোগ করেছে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রামিত ১ লাখ ৪৫ হাজারের বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যা ১,৮৪৭ অর্থাৎ মৃত্যুর হার ১.২৭ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা খুবই ভালো বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে যখন চিকিৎসক মৃত্যুর হারে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষে দেখা যায়, তখন দেশে-বিদেশে এর প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়ভাবে নেতিবাচক।
দীর্ঘ তিনমাস বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ টেস্টের মূল্য সাড়ে ৩০০০ টাকা থাকায় টেস্ট অনেক কম হয়েছে। চলতি সপ্তাহে র্যাপিড টেস্টের ফি সরকার নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, তাই এখন প্রচুর সংখ্যক টেস্ট করা হচ্ছে। পজিটিভ শনাক্তও হচ্ছে অনেক বেশি।
গতকাল জার্মান পার্লামেন্ট (বুন্ডেসটাগ) আর এক দফা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, করোনা মহামারিতে জনগণের জন্যে এই বছরের মূল্য সংযোজন কর (VAT) ১৯ থেকে ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। অর্থনীতিতে পরিবারগুলোকে বাড়তি খরচ থেকে রেহাই দিতে, প্রতিটি শিশুর জন্যে (১৮ বছর পর্যন্ত) মাথাপিছু ৩০০ ইউরো ‘শিশুভাতা’ দেওয়া হবে (আগে ছিল ২১০ ইউরো)।
এই ধরনের সব সিদ্ধান্ত জার্মান পার্লামেন্টের ৭০৯ সদস্যের ভোটে বিল আকারে পাশ হয়। চ্যান্সেলর এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
জার্মানির আর একটি তথ্য দিয়ে শেষ করি, ২০১৯ সালের অর্থবছরের জার্মানির ফেডারেল বাজেট ছিল ৩৪২ বিলিয়ন ইউরো। যার ৪০ শতাংশ বরাদ্দ ছিল শ্রম ও সামাজিকবিষয়ক পরিবার ও শিশু-কিশোর মন্ত্রণালয়ের জন্যে। এর পরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ১০ শতাংশ। তৃতীয়স্থানে দেশরক্ষা মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ মন্তব্য হলো: পশ্চিমের দেশগুলোকে উদাহারণ হিসেবে নিয়ে বাংলাদেশ এই করোনা মহামারিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে দেশের জনগণের জন্যে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে করোনা পরবর্তীতে অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশকে ভীষণ দূর্যোগের মধ্যে পড়তে হবে।
মীর মোনাজ হক, জার্মানিতে কলামিস্ট হিসেবে জার্মান, ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় লেখালেখি করেন
Comments