রোগীদের শ্বাসকষ্ট আরও বাড়ছে অক্সিজেনের ‘ভুতুড়ে’ বিলে

গত জুন মাসের শুরুর দিকে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হন জান্নাতুল ফেরদৌস। ৪৫ বছর বয়সী এই নারীকে ১০ দিন অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় তার পরিবারের হাতে ছয় লাখ টাকারও বেশি অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র অক্সিজেনের বিল তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা।

গত জুন মাসের শুরুর দিকে প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হন জান্নাতুল ফেরদৌস। ৪৫ বছর বয়সী এই নারীকে ১০ দিন অক্সিজেন দিতে হয়েছিল। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে যাওয়ার সময় তার পরিবারের হাতে ছয় লাখ টাকারও বেশি অঙ্কের বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে শুধুমাত্র অক্সিজেনের বিল তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা।

অতিরিক্ত এই বিলের হাত থেকে নিস্তার পেতে প্রায় ছয় ঘণ্টা নিরন্তর চেষ্টা চালান তার স্বামী ইসহাক। ক্ষমতাসীন দলের পরিচিত প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। অবশেষে ১৪ জুন প্রায় চার লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করে হাসপাতাল ছাড়তে হয় তাদের।

অক্সিজেনের জন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অতিরিক্ত চার্জ নেওয়ার এমন অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে অহরহই।

রাজধানীতে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে। এমনটিই জানিয়েছেন রাজধানীর পাঁচটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে অযৌক্তিকভাবে উচ্চ পরিমাণে চার্জ নিচ্ছে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। এমনটি হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে অক্সিজেনের জন্য কত ফি নেওয়া যাবে সেই বিষয়ে সরকারি নীতিমালা না থাকা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘সরকারের উচিত অবিলম্বে অক্সিজেনের জন্য চার্জ ঠিক করে দেওয়া।’

যুক্তিসঙ্গত চার্জ

জান্নাতুল ফেরদৌসের কিশোরী কন্যা আইমন জানান, ম্যাক্স হাসপাতালের অভিজ্ঞতা তাকে মানসিক আঘাত দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার তাদের জিজ্ঞাসা করেছি কেন তারা অক্সিজেনের জন্য এত বেশি চার্জ নিচ্ছে এবং তাদেরকে চার্জের পরিমাণ কমানোর জন্য বলি। কিন্তু, তারা কিছুতেই আমাদের কথা শোনেনি।’

অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিন্ডেস্পেকট্রার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এক হাজার ৩৬০ লিটারের একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করা যায় প্রায় ১০০ টাকায়।

কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীরা গুরুতর ফুসফুসের সংক্রমণসহ অক্সিজেনের অভাবে ভোগেন। এক হাজার ৩৬০ লিটারের একটি সিলিন্ডার তাদের প্রায় চার ঘণ্টা পর্যন্ত প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে। তবে, বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে (যাদের অবস্থা গুরুতর নয়) প্রতি মিনিটে দুই লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। সেক্ষেত্রে এই মাপের সিলিন্ডার ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় চলতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

দ্য ডেইলি স্টার ঢাকা ও চট্টগ্রামের ১০টি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তারা অক্সিজেনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ২০০ থেকে ৪০০ টাকা চার্জ নিচ্ছে।

হাসপাতালগুলোর কর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, মহামারি শুরু হওয়ার আগে এই চার্জ ছিল ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রামে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ দলের সদস্য এবং ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘চাহিদা ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা এখন অক্সিজেনের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টাকা চার্জ করি। যদি এইচএফএনসির মাধ্যমে অক্সিজেন দেই সেক্ষেত্রে চার্জ প্রতি ঘণ্টায় ৪০০ টাকা।’

জান্নাতুল ফেরদৌসের বিলের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা সফটওয়্যারের ভুল হতে পারে।’

তবে, জান্নাতুল ফেরদৌসের স্বামী ইসহাক বলেন, ‘তারা কীভাবে বলতে পারে যে এটা ভুল ছিল? আমরা সারাদিন ধরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিলের বিষয়টি দেখার জন্য অনুরোধ করেছি। এমনকি এমডি নিজেও সেখানে ছিলেন।’

হাসপাতালগুলো বলছে খরচ বেড়েছে

বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুবিন খান বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেনের যে বিল দেওয়া হচ্ছে, সেখানে শুধুই অক্সিজেনের দাম ধরা নেই। করোনার মধ্যে হাসপাতালগুলো চিকিত্সক ও অন্যান্য কর্মচারীদের অনেক বেশি বেতন দিচ্ছে এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিত্সা বেসরকারি মেডিকেল হাসপাতালের জন্য তেমন লাভজনক নয়, যেমনটি আপনারা ভাবেন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, ‘করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে যদি বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় বেশি বেড়ে যাওয়ার দাবি সত্য হয়, তাহলে সরকারের উচিত ভর্তুকি দেওয়া। যাতে অক্সিজেনের দাম ও চিকিত্সা স্থিতিশীল থাকে।’

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘সরকারের এ বিষয়ে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থাকা উচিত।’

‘সরকারের নিয়ন্ত্রণের অভাবই কিছু হাসপাতাল “নির্মম প্রতিষ্ঠান” হয়ে উঠছে’, যোগ করেন তিনি।

কোনো নজরদারি নেই

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসের অতিরিক্ত কমিশনার (উন্নয়ন) এবং কোভিড-১৯ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ দলের আহ্বায়ক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, তারা বেসরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের চিকিত্সা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। তবে, এর ব্যয় পর্যবেক্ষণ করেন না।

প্রায় নিয়মিতভাবেই অক্সিজেনের দাম বেশি রাখা বিষয়ক প্রতিবেদন গণমাধ্যমে আসা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আমিনুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি এ জাতীয় কোনো অভিযোগ শোনেননি।

লুণ্ঠিত হচ্ছে জনগণ

রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে মে ও জুন মাসে চিকিৎসা করাতে আসা অন্তত তিন জন রোগীর পরিবারের অভিযোগ, অক্সিজেনের জন্য তাদের কাছ থেকে অযৌক্তিক চার্জ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘তাদের ভুল’ স্বীকার করে কিছু টাকা ফেরত দিয়েছিল।

৬৭ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে গত মাসে ১৪ দিন ভর্তি ছিলেন রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে। এক ঘণ্টারও কম সময় সেবা দিয়েও ৮৬ হাজার ৪০০ টাকার অক্সিজেন বিল দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার ছেলে তৌহিদুল হক সোহেল।

মোট বিল দেওয়া হয়েছিল তিন লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৯ টাকার।

যোগাযোগ করা হলে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক জানান, হাসপাতালের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে অক্সিজেনের চার্জ বাড়ছে।

তিনি বলেন, ‘তবুও, রোগীর পরিবার যদি আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে, তাহলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

Comments

The Daily Star  | English

Ex-public administration minister Farhad arrested

Former Public Administration minister Farhad Hossain was arrested from Dhaka's Eskaton area

3h ago